মুলা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও স্বল্পকালীন সবজি। মুলা একটি পুষ্টিকর সবজি হলেও অনেকেই এটি খেতে পছন্দ করেন না। মুলাতে রয়েছে ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, লৌহ ও প্রচুর পরিমাণে পানি, যা শরীরের জন্য উপকারী। বিশেষ করে শীতকালে মুলা খাওয়া শরীর ঠান্ডা রাখে এবং হজমে সহায়তা করে। এই পোস্টে মুলা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকেরা শুধুমাত্র শীত মৌসুমেই নয়, বরং অমৌসুমেও মুলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কারণ, উন্নত জাতের মুলা এখন সারা বছর চাষ করা যায় এবং এটি কৃষকদের জন্য লাভজনক একটি ফসল।
🧑🌾 মুলা চাষের জন্য জমি ও মাটির প্রস্তুতি
মুলা চাষের জন্য উঁচু, মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু জমি উপযুক্ত। তবে জমি অবশ্যই সুনিষ্কাশিত ও আলগা বেলে দোআঁশ মাটি হওয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) অনুযায়ী, এটেল মাটিতে মুলার বৃদ্ধি কম হয় কারণ এর শিকড় সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না।
জমি প্রস্তুতের সময় মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করতে হবে এবং প্রয়োজনে ২–৩ বার চাষ দিয়ে মই দিতে হবে। জমিতে জৈব সার যেমন পচা গোবর, ছাই ও কম্পোস্ট সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে মুলার বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং ফলনও বাড়ে।
🌱 মুলার জনপ্রিয় জাতসমূহ ও তাদের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৫টিরও বেশি জাতের মুলা চাষ হচ্ছে। একসময় শুধুমাত্র জাপানের বিখ্যাত তাসাকি সান জাতের মুলাই পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন স্থানীয় ও বিদেশি হাইব্রিড জাতের প্রচলন ঘটেছে, যেগুলো দ্রুত ফলন দেয় ও রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।
🔹 বারি মুলা-১ (তাসাকি সান)
- বীজ বপনের সময়: ভাদ্র থেকে কার্তিক।
- ফসল তোলার সময়: ৪০–৪৫ দিন পর।
- বৈশিষ্ট্য: ধবধবে সাদা, লম্বা ও বেলুনাকৃতি।
- গড় দৈর্ঘ্য: ৩৫ সেমি।
- গড় ওজন: ১ কেজি।
- ফলন: ৬৫–৭০ টন প্রতি হেক্টর।
🔹 বারি মুলা-২ (পিংকি)
- বীজ বপনের সময়: ভাদ্র–কার্তিক।
- বৈশিষ্ট্য: লালচে রঙের, নলাকৃতি, মাঝারি আকার, ও দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৫-৩০ সেন্টিমিটার।
- গড় ওজন: ৯০০ গ্রাম।
- শাক খাওয়ার উপযোগী।
- ফলন: ৬৫–৭০ টন প্রতি হেক্টর।
🔹 বারি মুলা-৩ (দ্রুতি)
- বীজ বপনের সময়: ভাদ্র–কার্তিক।
- বৈশিষ্ট্য: সাদা, নলাকৃতি, ও রোগ পোকার আক্রমণ প্রতিরোধী। পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো। মুলার অর্ধেক অংশ মাটির উপরে থাকে।
- গড় ওজন: ৪০০–৬০০ গ্রাম।
- জীবনকাল: ৪০–৪৫ দিন।
- বীজ উৎপাদনে উপযুক্ত। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১.২-১.৩ টন বীজ পাওয়া যায়।
- ফলন: ৪০–৪৫ টন প্রতি হেক্টর।
🔹 এভারেস্ট এফ১
- সারা বছর চাষযোগ্য।
- বীজ বোনার ৪০–৪৫ দিন পর ফলন।
- বৈশিষ্ট্য: সাদা, নলাকৃতি, ও ছোট আকারের।
- গড় ওজন: ৪০০-৫০০ গ্রাম।
- শাক খাওয়ার উপযুক্ত।
- ফলন: ৫০–৬০ টন প্রতি হেক্টর।
🔹 হোয়াইট প্রিন্স এফ১
- বীজ বপনের সময়: ভাদ্র–কার্তিক।
- বৈশিষ্ট্য: আগাম, দ্রুত বর্ধনশীল, ঝাঁঝহীন ও সুস্বাদু। শাক খাওয়ার উপযুক্ত।
- গড় ওজন: ৩০০–৪০০ গ্রাম।
- ফলন: ৫০–৬০ টন প্রতি হেক্টর।
🔹 মিনো আর্লি লং হোয়াইট
- বীজ বপনের সময়: আশ্বিন–অগ্রহায়ণ।
- বৈশিষ্ট্য: বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মুলা তোলা যায়। মুলা লম্বা, সাদা, গ্রীস্মকালে ভাল হয়।
- ফলন সময়: পৌষ–ফাল্গুন।
- গড় ওজন: ২৫০–৪০০ গ্রাম।
- ফলন: ৪০–৫০ টন প্রতি হেক্টর।
🌾 বীজ বপনের সময় ও হার
বাংলাদেশে সাধারণত আশ্বিন থেকে কার্তিক মাসের মধ্যে মুলার বীজ বপন করা হয়। প্রতি হেক্টরে ২.৫–৩ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিটিয়ে বপন করা হলেও সারিতে বপন করলে পরিচর্যা সহজ হয়।
সারিতে বপনের ক্ষেত্রে:
- সারির দূরত্ব: ২৫–৩০ সেমি।
- গাছের দূরত্ব: ৩০ সেমি।
💧 সার ব্যবস্থাপনা
সঠিক সার প্রয়োগ মুলা চাষে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করে। নিচে প্রতি শতক ও প্রতি হেক্টরের জন্য সারের মাত্রা উল্লেখ করা হলো।
| সারের নাম | প্রতি শতকে (কেজি) | প্রতি হেক্টরে (কেজি) |
| ইউরিয়া | ১.২–১.৪ | ৩০০–৩৫০ |
| টিএসপি | ১.০–১.২ | ২৫০–৩০০ |
| এমওপি | ০.৮৫–১.৪ | ২১৫–৩০০ |
| গোবর সার | ৩২–৪০ | ৮–১০ টন |
সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
- জমি তৈরির সময় সব জৈব সার, টিএসপি ও অর্ধেক এমওপি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমওপি দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে—বীজ বপনের তৃতীয় ও পঞ্চম সপ্তাহে।
- সার প্রয়োগের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে।
- বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বোরিক পাউডার/বোরাক্স ব্যবহার করা আবশ্যক। প্রতি হেক্টরে ১০–১৫ কেজি বোরিক এসিড/বোরাক্স প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট।
🌿 পরিচর্যা ও যত্ন
- পাতলা করা: বীজ বপনের ৭–১০ দিন পর অতিরিক্ত চারা তুলে পাতলা করতে হবে।
- সেচ: মাটিতে আর্দ্রতা কমে গেলে সেচ দিতে হবে।
- আগাছা দমন: নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- মাটি আলগা রাখা: মাটি শক্ত হলে নিড়ানী দিয়ে ভেঙে দিতে হবে।
🐛 পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
মুলা গাছে বিভিন্ন ধরণের পোকামাকড় আক্রমণ করে থাকে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
- পাতার বিটল (Flea Beetle): ছোট ছোট ছিদ্র করে ক্ষতি করে।
- করাত মাছি (Mustard Saw Fly): পাতা খেয়ে গাছ দুর্বল করে ফেলে।
- ঘোড়া পোকা ও বিছা পোকা: পাতার ক্ষতি করে।
- জাব পোকা (Aphid): বীজ উৎপাদনের সময় বেশি ক্ষতি করে।
👉 প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে দমন করতে পারেন যেমন নিমপাতা নির্যাস স্প্রে বা লাল মরিচ ও সাবানের মিশ্রণ ব্যবহার। প্রয়োজনে বিভিন্ন কীটনাশক, যেমন— ইমিডাক্লোপ্রিড, সাইপারমেথ্রিন, ক্লোরপাইরিফস, এমামেকটিন বেনজোয়েট ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
🦠 রোগ ব্যবস্থাপনা
মুলার সাধারণ রোগসমূহ:
- অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ (Alternaria leaf spot): পাতায় ছোট বাদামী দাগ দেখা যায়।
- হোয়াইট স্পট রোগ: পাতায় সাদা দাগ হয় ও ফলনের ক্ষতি করে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
- বীজ বপনের আগে বীজকে ছত্রাকনাশক দ্রবণে ভিজিয়ে নিতে হবে।
- রোগাক্রান্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- জমি জলাবদ্ধতামুক্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে।
- প্রয়োজনে বিভিন্ন ছত্রাকনাশক, যেমন— কার্বেন্ডাজিম, কপার অক্সিক্লোরাইড, মেনকোজেব ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
🧺 ফসল সংগ্রহ ও ফলন
মুলা কচি অবস্থায় তোলা সবচেয়ে ভালো। দেরি করলে মুলা শক্ত ও আঁশযুক্ত হয়ে যায়। হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়।
- বীজ বোনার ৪০–৪৫ দিন পর মুলা সংগ্রহ করা যায়।
- প্রতিটি মুলার গড় ওজন ৩০০–১০০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়।
- জাত ও যত্ন অনুযায়ী প্রতি হেক্টরে ফলন ৪০–৬০ টন পর্যন্ত হতে পারে।
ফসল সংগ্রহের পর শীতল স্থানে রাখলে মুলা ৫–৭ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
🥗 পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
মুলা শুধু একটি সবজি নয়, এটি একটি ওষধিগুণসম্পন্ন খাদ্য। এতে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, এবং পটাশিয়ামের ভালো উৎস রয়েছে।
মুলার উপকারিতা:
- হজমে সহায়তা করে
- লিভারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে
- কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে
- ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
🌸 উপসংহার
মুলা একটি স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অত্যন্ত লাভজনক সবজি। সঠিক সময়ে চাষ, সুষম সার ব্যবস্থাপনা ও রোগ-পোকার দমন করলে প্রতি হেক্টরে ৬০ টনেরও বেশি ফলন সম্ভব। এটি কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও দেশের সবজি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তাই নতুন ও পুরনো কৃষক—সবাইকে মুলা চাষে উৎসাহী হওয়ার আহ্বান জানানো যায়।
🌿 মুলা চাষ পদ্ধতি: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
মুলা চাষের জন্য কোন ধরনের মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত?
মুলা চাষের জন্য বেলে দোআঁশ ও সুনিষ্কাশিত মাটি সবচেয়ে ভালো। এই ধরনের মাটি মুলার শিকড়কে সহজে বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। এটেল মাটিতে মুলা শক্ত ও বিকৃত হয়ে যেতে পারে।
মুলা চাষের জন্য উপযুক্ত মৌসুম কোনটি?
বাংলাদেশে সাধারণত আশ্বিন থেকে কার্তিক মাস মুলা বপনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে উন্নত হাইব্রিড জাত যেমন এভারেস্ট এফ১ বা হোয়াইট প্রিন্স এফ১ ব্যবহার করলে সারা বছরই মুলা চাষ সম্ভব।
প্রতি হেক্টরে কত পরিমাণ মুলার বীজ প্রয়োজন হয়?
সাধারণত প্রতি হেক্টরে ২.৫ থেকে ৩ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। ছিটিয়ে বা সারিতে বপন করা যায়। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারির দূরত্ব ২৫–৩০ সেমি এবং গাছের দূরত্ব ৩০ সেমি রাখতে হয় যাতে গাছ পর্যাপ্ত আলো ও পুষ্টি পায়।
মুলা চাষে কী ধরনের সার ব্যবহার করতে হয়?
ভালো ফলনের জন্য সুষম সার ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। নিচে প্রতি হেক্টরের হিসাবে সারের পরিমাণ দেওয়া হলো—
- ইউরিয়া: ৩০০–৩৫০ কেজি
- টিএসপি: ২৫০–৩০০ কেজি
- এমওপি: ২১৫–৩০০ কেজি
- গোবর সার: ৮–১০ টন
জমি তৈরির সময় জৈব সার ও অর্ধেক এমওপি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকি ইউরিয়া ও এমওপি দুই কিস্তিতে দিতে হবে।
মুলা গাছে কোন কোন রোগ-পোকা বেশি আক্রমণ করে?
মুলা গাছে সাধারণত নিচের পোকা ও রোগগুলো বেশি দেখা যায়ঃ
পোকামাকড়:
- পাতা বিটল (Flea Beetle)
- করাত মাছি (Mustard Saw Fly)
- ঘোড়া পোকা ও জাব পোকা
রোগসমূহ:
- অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ
- হোয়াইট স্পট রোগ
মুলা কতদিন পর তোলা যায়?
অধিকাংশ জাতের মুলা বীজ বোনার ৪০–৪৫ দিনের মধ্যে তোলার উপযোগী হয়। তবে জাতভেদে সময় কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কচি অবস্থায় তোলা মুলা খেতে মিষ্টি, ঝাঁঝহীন ও বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়।
মুলা চাষে প্রতি হেক্টরে ফলন কত হয়?
ভালো জাত ও যত্ন নিলে প্রতি হেক্টরে ৪০–৬০ টন পর্যন্ত মুলা ফলন পাওয়া যায়। যেমন, বারি মুলা-১ জাতের ফলন ৬৫–৭০ টন পর্যন্ত হতে পারে, আর বারি মুলা-৩ জাতের ফলন গড়ে ৪৫ টন।
মুলা সংরক্ষণ করার সেরা উপায় কী?
ফসল তোলার পর মুলা ঠান্ডা ও বায়ু চলাচলযোগ্য স্থানে রাখলে ৫–৭ দিন পর্যন্ত তাজা থাকে। দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেশনে ০–৪°C তাপমাত্রা ও ৯০–৯৫% আর্দ্রতা বজায় রাখা সবচেয়ে উপযুক্ত।
মুলার পুষ্টিগুণ কী কী?
মুলা একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, পটাশিয়াম ও ফাইবার রয়েছে। এটি হজমে সাহায্য করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
মুলা চাষ কি লাভজনক?
হ্যাঁ, মুলা চাষ লাভজনক।
মুলা একটি স্বল্পমেয়াদি ও কম খরচের উচ্চফলনশীল ফসল। অমৌসুমে মুলা চাষ করলে বাজারে বেশি দাম পাওয়া যায়। এক হেক্টর জমিতে সঠিক যত্ন ও ব্যবস্থাপনায় ৬০ টনেরও বেশি ফলন সম্ভব, যা কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক।
আপনি যদি শাকসবজি চাষে আগ্রহী হন, তাহলে ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি সম্পর্কেও জানতে পারেন।



