আম (Mango) বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রিয় ফলগুলোর একটি। এর সুগন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টিগুণের কারণে আমকে “ফলরাজ” বলা হয়। শুধু খাওয়ার জন্য নয়, অর্থকরী ফসল হিসেবেও আম চাষ কৃষকের জন্য লাভজনক। তবে ফলন বাড়াতে এবং গাছ সুস্থ রাখতে চাই সঠিক পরিকল্পনা ও যত্ন। এই লেখায় আম চাষের শুরু থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
আম গাছের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি
- ইংরেজি নাম: Mango
- বৈজ্ঞানিক নাম: Mangifera indica
- পরিবার: Anacardiaceae
আম গাছ একটি চিরসবুজ ও দীর্ঘজীবী বৃক্ষ, যা সাধারণত ৭.৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। এ গাছের প্রধান কান্ডটি সরল এবং প্রকান্ড হয়ে থাকে। এর উপরই শাখা প্রশাখা জন্মে ক্রমে ছাতার রূপ নেয়। এর বিস্তার ৬-১৮ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাতা দীর্ঘ, বর্শাকৃতি ও মসৃণ। পাতাগুলো প্রশাখার গায়ে সর্পিলাকারে বা স্পাইরালী বিন্যস্ত থাকে। শিকড় দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী।
আমের পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ
🍃 পুষ্টিগুণ
আমে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন, ভিটামিন C, ও ক্যালোরি থাকে। এটি শরীরে শক্তি জোগায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
🌿 ঔষধিগুণ
- আয়ুর্বেদীয় ও ইউনানী পদ্ধতির চিকিৎসায় পাকা ফল ল্যাকজেটিভ, রোচক ও টনিক বা বলকারকরূপে ব্যবহৃত হয়।
- পাকা আম লিভার বা যকৃতের জন্য উপকারী
- কাঁচা আম ও পাকা আম রাতকানা ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে সহায়ক
- রক্ত পড়া বন্ধকরণে আম গাছের বিভিন্ন অঙ্গের রস উপকারী
- কচি পাতার রস দাঁতের ব্যথা দূর করে
- আমের শুকনো মুকুল পাতলা পায়খানা, পুরাতন আমাশয় এবং প্রসাবের জ্বালা যন্ত্রণা উপশম করে
- গাছের আঁঠা চর্মরোগ ও পায়ের ফাটায় কার্যকর
- আম পাতার গুঁড়া জ্বর, বুকের ব্যথা ও বহুমূত্র রোগে উপকারী
🔗 আরও পড়ুন: আমের স্বাস্থ্য উপকারিতা – WebMD
জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি
- উপযুক্ত মাটি: সুনিস্কাশিত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি আম চাষের জন্য উত্তম।
- উপযুক্ত সময়: সাধারনত ১৬ ই ফাল্গুন হতে ১৫ ই বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে জমি তৈরি করা উত্তম।
- প্রস্তুতির ধাপ: চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল ও আগাছামুক্ত করতে হবে।
আম চাষের বংশবিস্তার পদ্ধতি
- বীজের মাধ্যমে: সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদি গাছ।
- কলমের মাধ্যমে: দ্রুত ফলন ও জাতের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
চারা রোপণের উপযুক্ত পদ্ধতি
- রোপণ পদ্ধতিঃ সমতল ভূমিতে বর্গাকার, আয়তাকার বা ষড়ভূজী, পাহাড়ী ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে রোপণ করা যায়।
- রোপণের সময়: জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস (মধ্য মে থেকে মধ্য জুলাই) আম কলম লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়।
- রোপণের দুরত্ব: ৮-১২ মিটার।
- গর্ত খনন: বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল-মধ্য মে) মাসে গর্ত খনন করতে হবে। প্রতিটি গতের্র আকার ১ মি. x ১মি. x ১মি. হবে।
- প্রতি গর্তে সারের পরিমাণঃ
সারের নাম | সারের পরিমাণ |
জৈব সার | ১০-২০ কেজি |
টিএসপি | ৪৫০-৫৫০ গ্রাম |
এমপি | ২০০-৩০০ গ্রাম |
জিপসাম | ২০০-৩০০ গ্রাম |
জিংক সালফেট | ৪০-৬০ গ্রাম |
- চারা রোপণ: গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর চারার গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে। চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছ প্রতি সার ব্যবস্থাপনা (বয়স ভিত্তিক)
বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমাণ নিম্নরূপ হবে-
গাছ প্রতি সারের পরিমাণ | একক | গাছের বয়স (বছর) | |||||
০২-০৪ | ০৫-০৭ | ০৮-১০ | ১১-১৫ | ১৬-২০ | ২০-এর উর্ধ্বে | ||
গোবর বা আবর্জনা পঁচা সার | কেজি | ১০-১৫ | ১৬-২০ | ২১-২৫ | ২৬-৩০ | ৩২-৪০ | ৪১-৫০ |
ইউরিয়া | গ্রাম | ২৫০ | ৫০০ | ৭৫০ | ১০০০ | ১৫০০ | ২০০০ |
টিএসপি | গ্রাম | ২৫০ | ২৫০ | ৫০০ | ৫০০ | ৭৫০ | ১০০০ |
এমপি | গ্রাম | ১০০ | ২০০ | ২৫০ | ৩৫০ | ৪৫০ | ৫০০ |
জিপসাম | গ্রাম | ১০০ | ২০০ | ২৫০ | ৩৫০ | ৪৫০ | ৫০০ |
জিংক সালফেট | গ্রাম | ১০ | ১০ | ১৫ | ১৫ | ২০ | ২৫ |
উল্লেখিত সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম বার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় (মধ্য মে থেকে মধ্য জুলাই) মাসে এবং ২য় বার আশ্বিন (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর) মাসে প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম ও জিংক সালফেট এক বছর পর পর প্রয়োগ করলেই চলবে।
সেচ ব্যবস্থাপনা
- চারা গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সেচ প্রয়োজন
- সার প্রয়োগের পর হালকা পানি সেচ দিতে হবে
- মুকুল বের হওয়ার ৩-৪ মাস আগে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে
- আমের মুকুল ফোটার শেষ পর্যায়ে ১ বার এবং ফল মটর দানার আকৃতি ধারন পর্যায়ে আবার ১ বার পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
ডাল ছাঁটাই ও পরিচর্যা
- গাছের প্রধান কান্ডটি যাতে সোজাভাবে ১ থেকে ১.৫ মিটার উঠে সেদিকে লক্ষ্য রেখে গাছের গোড়ার অপ্রয়োজনীয় শাখা কেটে ফেলতে হবে।
- গাছের ভিতরে যাতে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে তার জন্য অভ্যন্তরের অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে ফেলতে হবে।
- রোগাক্রান্ত, শুকনো, মরা ও দুর্বল শাখাগুলি সর্বদাই কেটে রাখতে হবে।
- কলমের গাছের বয়স ৪ বছর পূর্ন না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙ্গে দিতে হবে।
রোগবালাই ও প্রতিকার
রোগের নাম | রোগের লক্ষণ | প্রতিকার |
এ্যানথ্রাকনোজ | ১) গাছের পাতা, কান্ড, মুকুল ও ফলে ধূসর বাদামি রংয়ের দাগ পড়ে। ২) মুকুল ঝরে যায়, আমের গায়ে কালচে দাগ হয় এবং আম পঁচে যায়। | ১) আমের মৌসুম শেষে গাছের মরা ডালপালা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। কাটা অংশে বর্দোপেষ্ট (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন) লাগাতে হবে। ২) গাছের নিচে পড়া মরা পাতা পুড়ে ফেলতে হবে। ৩) গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ডাইথেন এম-৪৫, ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আমের আকার মটর দানার মত হলে ২য় বার স্প্রে করতে হবে। |
পাউডারী মিলডিউ | ১) আমের মুকুলে সাদা পাউডারের মত আবরন দেখা যায় এবং মুকুল ঝরে যায়। ২) আমের ত্বক খসখসে হয় এবং কুঁচকে যায়। | ১) গাছে মুকুল আসার পর এক বার এবং ফল মটর দানা আকারের হলে আর এক বার থিওভিট প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। |
ডাইব্যাক | ১) গাছের কচি ডালের আগা শুকিয়ে মরে যেতে থাকে। গাছের আম ঝরে পড়ে। | ১) সুস্থ অংশসহ ডাল কেটে ফেলতে হবে এবং ডায়থেন এম-৪৫ (০.২%) ব্যবহার করতে হবে। |
পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা
নাম | ক্ষতির ধরন | প্রতিকার |
আমের শোষক পোকা | ১) মুকুলের রস চুষে খায় এবং এতে মুকুল শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। ২) এই পোকা আঠালো মধুরস ত্যাগ করার কারনে মুকুলের পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটায়। এছাড়া ফুল ও পাতায় মধুরসের কারণে ভূষা ছত্রাকের জন্ম হয়। | ১) গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ফুল ফোটার পূর্বে প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মি.লি. সিমবুশ ১০ ইসি/ফেনম ১০ ইসি/বাসাথ্রিন ১০ ইসি মিশিয়ে পাতা, ফুল ও ডালপালায় স্প্রে করতে হবে। এর এক মাস পর একই পদ্ধতিতে আবার স্প্রে করতে হবে। |
আমের ভোমরা পোকা | ১) এই পোকার কীড়া কচি আম ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং ফল বড় হবার সাথে সাথে ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাইরে থেকে ফল ভাল দেখা গেলেও ভিতরে কীড়া পাওয়া যায়। | ১) প্রতি লিটার পানিতে ২ মি.লি. লিবাসিড ৫০ ইসি/সুমিথিয়ন ৫০ ইসি/ডায়াজিনন ৫০ ইসি মিশিয়ে ফল আসার ১০-১২ দিন পর থেকে ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। |
আমের মাছি পোকা | ১) আম পাকার সময় স্ত্রী মাছি আমের গা ছিদ্র করে আমের মধ্যে ডিম পাড়ে। ঐ সমস্ত ডিম হতে কীড়া বের হয়ে ফলের শাঁস খেতে থাকে এবং ঐ আম কাটলে তাতে অসংখ্য কীড়া বের হয়। | ১) ১ মি.লি ডেসিস ২.৫ ইসি প্রতি লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে আম সংগ্রহের ৩৫-৪০ দিন পূর্বে স্প্রে করতে হবে। এর ১৫ দিন পর আরও একবার স্প্রে করতে হবে। ২) গাছে আম পোক্ত হলে অর্থাৎ পাকার আগেই সংগ্রহ করতে হবে। |
অনিয়মিত ফল ধারণ সমস্যার প্রতিকার
কোন কোন আম গাছে এক বছর আম ধরে কিন্তু পরের বছর বা ২-৩ বছর ফুল-ফল ধরে না। এজন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে-
- নিয়মিত ফলদানকারী জাত নির্বাচন (যেমন: হিমসাগর) করতে হবে।
- বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে বাগানে চাষ দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।
- ফল সংগ্রহের পর গাছপ্রতি ১.৫ কেজি ইউরিয়া ব্যবহার করলে নতুন পাতা গজিয়ে ফুল-ফল ধরতে পারে।
- গাছের পরগাছাসহ মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল-পালা ভাদ্র মাসের দিকে ছেঁটে দিতে হবে।
- গাছের বাড়-বাড়তি বেশী হলে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বড় বড় ডালের বাকল গোল করে ২ সে.মি. পরিমান উঠিয়ে ফেলতে হবে।
- গাছের গোড়ার চারদিকে কুপিয়ে ৩-৪ কেজি লবণ দিয়ে পানি দিলেও উপকার পাওয়া যায়।
- হরমোন ছিটালেও গাছে ফুল ধরতে সহাযক হয়।
ফল ঝরার প্রতিকার
- সুষম সার ব্যবহার ও পরিমিত সেচ প্রদান
- পোকামাকড় ও রোগ দমন
- কম ফল ঝরে এমন জাত নির্বাচন
- পরাগায়নে সহায়তার জন্য বাগানে মৌমাছি পালন
- বাগানের চারদিকে বাত্যারোধী গাছ রোপন
- পরিমিত ছাটাইকরণ, নিয়মিতভাবে আন্তপরিচর্যাকরণ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক (২,৪-ডি ২০ পিপিএম) প্রয়োগ।
ফল সংগ্রহ ও উৎপাদন
ফল পরিপক্বতার লক্ষণ
কলমের গাছ থেকে বেশ তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায় কিন্তু বীজের গাছের জন্য প্রায় ৮-১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ফল ধরার ৩-৫ মাসের মধ্যেই ফল পরিণত বা বাত্তি হয়। তখন নিম্নোক্ত লক্ষনসমূহ দেখে ফল সংগ্রহ করতে হবে-
- বোঁটার নীচের অংশ কিছুটা হলুদাভ বর্ন ধারন করবে।
- আম পরিপক্ক অবস্থায় পানিতে ডুবে যাবে।
- এক-দুটা আম ঝরে পড়বে।
- আম পরিপক্ক হলে কস বের হয়ে দ্রুত শুকিয়ে যাবে।
উৎপাদন ক্ষমতা
- একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ থেকে ৫০০-৩০০০টি আম পাওয়া যেতে পারে
সাথী ফসল চাষ
আমের চারা লাগানোর প্রথম ৫-৭ বছর পর্যন্ত শাক-সবজি, সরিষা, ছোলা, মসুর ও অন্যান্য ডাল, পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতির চাষ করা যায়। গাছ বড় হলেও আম বাগানে আদা, হলুদ, পান ইত্যাদির চাষ করা যেতে পারে।
উপসংহার
সঠিক পরিকল্পনা, সঠিক সময়ে চাষ ও যত্ন এবং রোগ-বালাই ও পোকামাকড় দমনের মাধ্যমে একজন কৃষক আম চাষ করে ভালো লাভ করতে পারেন। বর্তমানে আম চাষ আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন কৃষি অধিদপ্তর এবং প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পাওয়া যায়, যা চাষিদের জন্য একটি বড় আশার জায়গা।