বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ, যেখানে অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের খাদ্য উৎপাদন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষায় সারের ভূমিকা অপরিসীম। সঠিক পদ্ধতিতে সারের ব্যবহার ফসলের ফলন বাড়ায়, মাটির উর্বরতা ধরে রাখে এবং কৃষককে আর্থিকভাবে লাভবান করে। আজকের আলোচনায় থাকছে—সার কী, সারের প্রকারভেদ, এবং সুষম সার প্রয়োগের গুরুত্ব ও কৌশল।
সার কী?
সার হলো এমন একটি পদার্থ যা মাটিতে প্রয়োগ করে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা হয়। সহজভাবে বলা যায়, মাটিতে কোনো নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করার জন্য যে উপাদান প্রয়োগ করা হয়, তাই সার। উদ্ভিদ বা ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি, বিকাশ ও অধিক ফলনের জন্য সার একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
সারের প্রকারভেদ
সারকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রতিটি শ্রেণির সারের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ পদ্ধতি রয়েছে।
১. জৈব সার
জীব বা জৈব পদার্থ থেকে উৎপাদিত সারকে জৈব সার বলা হয়। এই ধরনের সার উদ্ভিদ ও প্রাণীর পঁচনশীল অংশ থেকে তৈরি হয়।
উদাহরণ:
- গোবর সার
- মুরগির বিষ্ঠা
- কম্পোস্ট
- খামারজাত সার
- সবুজ সার (যেমন: ধৈঞ্চা)
- হাড়ের গুঁড়া
- মাছের গুঁড়া
উপকারিতা:
- মাটির গঠন ও উর্বরতা বাড়ায়
- মাটির জীবাণুর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে
- পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষির সহায়ক
২. রাসায়নিক সার
যে সকল সার শিল্পকারখানায় প্রস্তুত করা হয় বা প্রাকৃতিক খনি থেকে উত্তোলন করা হয়, তাদের রাসায়নিক সার বলা হয়।
উদাহরণ:
- ইউরিয়া
- টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট)
- ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট)
- জিংক সালফেট
- ম্যাগনেশিয়াম সালফেট
- মিউরেট অব পটাশ
- পটাশিয়াম সালফেট
উপকারিতা:
- দ্রুত কাজ করে
- নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান সরবরাহ নিশ্চিত করে
- ফলন দ্রুত বৃদ্ধি করে
মধ্যপন্থা: অতিরিক্ত বা এককভাবে ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ হ্রাস পেতে পারে।
৩. মিশ্র/যৌগিক সার
দুই বা ততোধিক পুষ্টি উপাদান যুক্ত সারকে মিশ্র বা যৌগিক সার বলা হয়।
উদাহরণ:
- এনপিকেএস (NPKS) মিশ্র সার
উপকারিতা:
- একাধিক পুষ্টি উপাদান একসাথে প্রদান
- প্রয়োগ সহজ
- সময় ও খরচ সাশ্রয়ী
৪. জীবাণু সার
যেসব সারে জীবন্ত বা সুপ্ত অবস্থায় উপকারী অণুজীব থাকে, সেগুলো জীবাণু সার হিসেবে পরিচিত।
উদাহরণ:
- রাইজোবিয়াম
- অ্যাজোটোব্যাক্টার
- পিএসবি (ফসফেট দ্রবণকারী ব্যাকটেরিয়া)
উদাহরণ ব্যবহার:
ছোলায় রাইজোবিয়াম সার প্রয়োগ করলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না, কারণ এটি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন নিয়ে গাছকে সরবরাহ করে।
সুষম সার প্রয়োগ: ফলনের জন্য মূল চাবিকাঠি
সুষম সার প্রয়োগ বলতে বুঝায়, ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময়ে প্রয়োগ করা। অনেক কৃষক কেবল ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকেন, যা মোটেই সুষম নয়।
সুষম সার প্রয়োগের উপকারিতা:
- ফসলের গুণমান ও ফলন বৃদ্ধি পায়
- মাটির স্বাস্থ্য উন্নত হয়
- সার অপচয় কম হয়
- দীর্ঘমেয়াদে কৃষির স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়
সুষম সার প্রয়োগ নির্ধারণের উপাদানসমূহ
সুষম সার প্রয়োগের জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয়—
- ফসলের পুষ্টি চাহিদা ও সময়
প্রতিটি ফসলের আলাদা চাহিদা আছে—তাই ফসল অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। - মাটির পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি
মাটির পরীক্ষা করে জানা যায় কোন উপাদানের ঘাটতি আছে। - সারের অপচয়
যেমন: বৃষ্টি, সেচ, বাষ্পীভবন ইত্যাদির কারণে সার অপচয় হয়। - ইতিপূর্বে প্রয়োগ করা সারের অবশিষ্ট প্রভাব
বিশেষ করে ফসফরাস ও পটাশের জন্য। - ইতিপূর্বে চাষকৃত ফসলের প্রভাব
যেমন: লিগিউম ফসলের বেলায় বায়বীয় নাইট্রোজেন মাটিতে জমা হয়। - চাষের উদ্দেশ্য
যেমন: বীজ, আঁশ বা পাতার জন্য উৎপাদন। - বর্ষায় পলি জমা হওয়ার মাত্রা
নতুন পলি জমলে অতিরিক্ত সার প্রয়োজন হয় না। - শস্যক্রম পদ্ধতি
এক জমিতে পরপর বিভিন্ন ফসল চাষ করলে সার প্রয়োগের কৌশল বদলায়। - সেচনির্ভর বা বৃষ্টিনির্ভর চাষ
পানির ব্যবস্থাপনার ওপর সার প্রয়োগ নির্ভর করে। - ফলনের লক্ষমাত্রা
উচ্চ ফলনের জন্য বেশি পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন।
কৃষকদের জন্য কিছু পরামর্শ:
- মাটি পরীক্ষা করে সার ব্যবহার করুন।
- জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয় করুন।
- একক ইউরিয়ার ব্যবহার পরিহার করুন।
- ফসলভেদে নির্ধারিত ডোজ মেনে চলুন।
- জীবাণু সার ব্যবহারে উৎসাহিত হোন।
উপসংহার
ফসলের গুণগতমান ও উৎপাদন বাড়াতে হলে সঠিক ও সুষমভাবে সার প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জৈব, রাসায়নিক, মিশ্র ও জীবাণু সার—সবকটির সমন্বিত ব্যবহারে মাটি ও ফসল দুটোই লাভবান হয়। সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, তেমনি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষির দিকেও এগিয়ে যেতে পারি।
📌 এই লেখাটি আপনার সহায়ক মনে হলে কৃষি সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং মাটির পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগে আগ্রহী হোন।