চন্দ্রমল্লিকা (ইংরেজি নাম: Chrysanthemum, বৈজ্ঞানিক নাম: Chrysanthemum indicum L.) বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ফুলগুলোর একটি। এর বিচিত্র বর্ণ, রূপ সব মিলিয়ে গোলাপের পরেই এ ফুলের জনপ্রিয়তা। এর ফুল চাঁদের মত দেখতে এবং পাপড়িগুলো মল্লিকা ফুলের মত হওয়ায় একে “চন্দ্রমল্লিকা” বলা হয়। গ্রিক শব্দ ‘ক্রিসস (Chrysos) ‘ অর্থ সোনা এবং ‘এনথিমাম (Anthemum)’ অর্থ ফুল—এই দুটি শব্দ মিলেই নাম হয়েছে ক্রিস্যানথিমাম (Chrysanthemum)। আবার ফুলটি ফোটেও খ্রিষ্টমাসের সময়ে।
চন্দ্রমল্লিকা জাপানের জাতীয় ফুল। একই জমিতে সাথী ফসল হিসাবে বিভিন্ন জাতের চন্দ্রমল্লিকা লাগিয়ে বছরে ২-৩ বার ফুল তোলা সম্ভব। চন্দ্রমল্লিকা শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দনই নয়, বরং চন্দ্রমল্লিকা চাষ খুব লাভজনক। বিশেষ করে সঠিক জাত নির্বাচন, সময়মতো চারা রোপণ, পরিচর্যা ও ফুল সংগ্রহ নিশ্চিত করলে কৃষকরা প্রতি বিঘা জমিতে লক্ষাধিক টাকা আয় করতে পারেন।
চন্দ্রমল্লিকা টবেও চাষ করা যায়। ফুলটি দেখতে সাদা, হলুদ, গোলাপি রঙের হয়। ফুল গন্ধহীন। গাছের উচ্চতা ২-৩ ফুট হয়।
চন্দ্রমল্লিকা চাষের উপযুক্ত সময় ও জলবায়ু
চন্দ্রমল্লিকা চাষ করা সহজ। শীতকালীন ফুল হলেও চাষ শুরু করতে হয় বর্ষাকালে।
চন্দ্রমল্লিকা চাষের জন্য আবহাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা গাছ সারা বছর বেঁচে থাকলেও ফুল ফোটে শীতকালে। ইহা দীর্ঘ দিবস, অধিক আলোক তীব্রতা ও অধিক তাপমাত্রা গাছের শুধু অঙ্গজ বৃদ্ধি ঘটায়। অধিকাংশ জাতেই রাতের দৈর্ঘ্য বা স্থায়ীত্বকাল ৯.৫ ঘণ্টার বেশি না হলে কুঁড়ি আসে না বা ফুল ফোটে না। রাতের দৈর্ঘ্য এর কম হলে গাছ শুধু দৈহিকভাবে বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা যদি ১০ডিগ্রি সে. বা তার নিচে নেমে যায় তাহলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়, কিন্তু তাপমাত্রা ১৫ডিগ্রি সে. এ উঠলেই গাছ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সে. এর উপরে উঠে গেলে কাণ্ড লম্বা ও চিকন হয়ে যায়। শাখা কলমের সময় যদি কয়েকদিন ধরে ১৬ ডিগ্রি সে. বা তার কাছাকাছি তাপমাত্রা বিরাজ করে তাহলে তাড়াতাড়ি শিকড় গজায়।
জনপ্রিয় চন্দ্রমল্লিকা জাতসমূহ
বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫,০০০+ জাত রয়েছে। তবে বিশেষভাবে উপযোগী কিছু জাতের তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
আগাম জাত (Early Varieties):
- সাদা: রোমাস, গ্লোব মাস্টার, শো-ড্যান্স
- হলুদ: ডিলাইট ফুল, স্টার ব্রাইট, হ্যারোল্ড পার্ক
- গোলাপি: এন্ট্রেস, ইউজীন, শীলারোজ, পিঙ্ক প্রাইড
- লাল: অ্যাপীল, রুবি কুইন, এস্টকর্ট, স্টার ফায়ার, রেড লিডার, রেড হেড
নাবি জাত (Late Varieties):
- সাদা: ফেভারেট, মেলেন, ক্রিম প্রেগ্রেস
- হলুদ: গোল্ডেনকারী, ইয়োলো সার্ভেল, ফোর্ড সুপ্রিম
- লাল: রেড ম্যাজেস্টিক, ক্রীমসন ভেলভেট, রাইজ-অব-ডে
জমি ও মাটি নির্বাচন
চন্দ্রমল্লিকা চাষের জন্য বেলে-দোআঁশ বা দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। পিএইচ মান ৬–৭ এর মধ্যে হলে ফুলের গুণাগুণ বেশি থাকে। জমি হতে হবে:
- পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত
- পর্যাপ্ত রৌদ্রপ্রাপ্ত
- আগাছামুক্ত
চারা তৈরির পদ্ধতি
চন্দ্রমল্লিকার সাকার বা শিকড় থেকে অথবা শাখা কলমের মাধ্যমে সাধারণত চারা তৈরি করা হয়। যদিও এ পদ্ধতিতে চারা তৈরির সময় মাতৃগাছ থেকে অনেক রোগ চারায় সংক্রমিত হতে পারে যার ফলে ফুলের গুণাগুণ ও ফলন কমে যায় তথাপি আজ পর্যন্ত চারা তৈরির এটাই ভালো পদ্ধতি।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে সাধারণত শাখাকলম করা হয়। বর্ষা জুড়েই কলম তৈরির কাজ চলে। বছরখানেক বয়স হলেই সে গাছ থেকে শাখা কলম করা যায়। এজন্য গত বছরের গাছের স্বাস্থ্যবান ডাল থেকে ৮–১০ সে.মি. লম্বা কাণ্ড যাতে অন্তত ২-৩টি গিঁট থাকে। কাণ্ড তেরছা ভাবে কেটে তার গোড়ায় সেরাডিক্স বি-১ নামক গুঁড়ো হরমোন লাগিয়ে তা মাটিতে বসিয়ে দিতে পারলে তাতে শিকড় গজায়। হরমোন না হলেও চলে তবে খেয়াল রাখতে হয় যেন মাটির নিচে অন্তত একটি গিঁট থাকে। মাসখানেক বয়স হলেই চারা রোপণের উপযুক্ত হয়।
চারা বীজতলা বা বেডে অথবা টবে যাতে গোড়াপচা রোগে আক্রান্ত না হয় সেজন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (যেমন ব্যাভিস্টিন) চারার গোড়ায় ছিটিয়ে দিতে হয়।
জমি প্রস্তুতি ও সার প্রয়োগ
জাত বুঝে আগাম, মাঝ ও নাবি মৌসুমে চন্দ্রমল্লিকার চাষ করা যায়। আগাম চাষের জন্য মাঘ থেকে ফাল্গুন এবং শীত মৌসুমে চাষের জন্য ভাদ্র—আশ্বিন মাসের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকার জন্য নির্বাচিত জমি সম্ভব হলে একটা চাষ দিয়ে ফেলে রেখে রোদ খাওয়াতে হবে। জমি যতটুকু পারা যায় গভীর করে চাষ দিতে হবে। ট্রাক্টর দিয়ে চাষ দিতে পারলে ভালো হয়। এ সময় জমিতে গুড়ো চুন ছিটাতে হবে। শেষ চাষের সময় জমির মাটির সাথে বিঘাপ্রতি ১-২ টন গোবর সার, ১০ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি ডিএপি, ৪০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে। জমিতে ৩ মিটার চওড়া এবং ৫ মিটার লম্বা বেড করতে হবে।
চারা রোপণের সঠিক সময় ও নিয়ম
আগাম চাষের জন্য বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে এবং শীতকালীন চাষের জন্য কার্তিকের মাঝামাঝি সময়ে চারা লাগাতে হবে। কাটিং লাগানো ভালো। সারি থেকে সারির দূরত্ব দেড় ফুট বা ৫০ সেণ্টিমিটার দিয়ে চারা বা কাটিং লাগানো যায়। তবে অধিকাংশ জাতের চারা সব দিকে ৩০ সেণ্টিমিটার দূরত্ব দিয়েও লাগানো যায়। এতে ফলন বেশি পাওয়া যায়। এই দূরত্ব দিলে বিঘাপ্রতি ১৪৫২০টি (একরে ৪৩৫৬০টি) চারা লাগে।
চারা বিকেলে লাগাতে হবে। লাগানোর পর ঝাঁঝরি দিয়ে গোড়ায় পানি দিতে হবে। চারা লাগানোর আগে চারার গোড়া প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা থিয়োভিট গুলে তাতে চারার গোড়া চুবিয়ে নিলে রোগ কম হয়। চারা লাগানোর পর নালা রেখে জমিতে বেড তৈরি করে দিতে হবে।
চন্দ্রমল্লিকা চাষে সার ব্যবস্থাপনা
জমি তৈরির শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি ৫-১০ টন গোবর, ২০০-২৫০ কেজি ইউরিয়া, ২০০-২৫০ কেজি টিএসপি এবং ৩০০-৩২০ কেজি মিউরেট অব পটাশ সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়।
চন্দ্রমল্লিকা ফুলের কলি ফোটার সময় প্রতি লিটার পানিতে ২ চা চামচ ইউরিয়া এবং মিউরেট অব পটাশ সার মিশিয়ে সেই তরল সার গাছে স্প্রে করলে গাছের চেহারা ভালো হয়। গাছে ফুল ফোটার সময় হলে এই তরল সার প্রয়োগ করলে ফুল ভালো হয়। তবে গাছে ফুল ফোটার পর স্প্রে না করাই ভালো।
টবে গাছ লাগালে রাসায়নিক সার প্রয়োগের বেশি প্রয়োজন হয় না। প্রতি ১০ ইঞ্চি টবের মাটি তৈরির জন্য দুই ভাগ পরিমাণ দেআঁশ মাটি, এক ভাগ পচা গোবর সার, ১৫-২০ গ্রাম টিএসপি, ৮-১০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ সার এবং পরিমাণমতো সরিষার খৈল মিহি গুঁড়ো করে একত্রে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে ৬-৭ দিন ভেজা অবস্থায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
চন্দ্রমল্লিকার পরিচর্যা
- আগাছা হওয়ার সাথে সাথে দমন করতে হবে।
- মাটি শুকিয়ে গেলে হালকা সেচ দিতে হবে।
- জলাবদ্ধতা হলে পানি নিকাশ করতে হবে।
- চন্দ্রমল্লিকার গাছ শক্ত না হলে বা লম্বা হলে বা হেলে পড়লে ফুল ভালো হয় না বা নষ্ট হয়। এজন্য গাছে সাপোর্ট দিতে হবে।
- জাত বুঝে গাছ ৪ ফুটের মধ্যে লম্বা রাখতে পারলে ভালো হয়। এতে গাছ শক্ত হয়, ফুলও ভালো হয়। এজন্য গাছকে প্রথমে ২ ফুট পর্যন্ত বাড়তে দিতে হবে। এরপর গাছের ডগা ভেঙে দিলে ৬-৭টা ডাল বের হবে। প্রথম কিস্তির ইউরিয়া সার দেয়ার ১৫-২০ দিনের মাথায় ডগা ভেঙে দিতে হবে। সেসব গাছে বেশি ফুল ফুটবে আর গাছও খাটো থাকবে।
- ফুল ফোটা শুরু হলে বা কুঁড়ি এলে মাথার কুঁড়ি বা ফুলটা রেখে তার বোঁটার নিচ থেকে গজানো অন্য কুঁড়িগুলো ১ ফুট পর্যন্ত ভেঙে দিতে হবে। এতে ফুলও বড় হবে।
✅ এই সব নিয়ম মানলে ফুল হবে স্বাস্থ্যবান, বড় এবং উজ্জ্বল রঙের।
ফুল সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ
- চারা রোপণের ১১০-১৩০ দিনের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকা ফুল ফোটে এবং ফুল ফোটার পর ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
- ভোর বেলা ফুল তোলার উপযুক্ত সময়। ফুল তোলার জন্য কাঁচির সাহায্যে ফুলের ডাঁটা কেটে নেওয়া ভালো।
- বাজারজাত করার জন্য ফুলের উপর সামান্য পানি ছিটিয়ে কালো পলিথিন মুড়ে বাজারে পাঠানো ভালো।
- গাছ থেকে চন্দ্রমল্লিকার ফুল তোলার পর ফুলে সূর্যালোক যত কম লাগে ততই ভালো। কারণ সূর্যালোকে ফুলের প্রকৃত রঙ ও উজ্জ্বলতা বজায় থাকে না।
ফলন ও লাভ
- হেক্টরপ্রতি ফলন: ৪–৫ লাখ ফুল
- বিঘা প্রতি ফলন: ৬০–৮০ হাজার ফুল
- গড়ে প্রতিগাছে ফুল হয়: ১০০–১৯০টি
💰 সঠিক পরিচর্যা করলে প্রতিফুল ১–৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি সম্ভব। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় লক্ষাধিক টাকা আয় সম্ভব।
চন্দ্রমল্লিকা চাষের উপকারিতা ও বাজার
- কম খরচে বেশি লাভ হয়।
- দেশীয় ও বিদেশি বাজারে চাহিদা বেশি।
- এটি রপ্তানিযোগ্য একটি ফুল।
- বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এর চাষ হচ্ছে—যেমন: যশোর, মধুপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল।
📎 আন্তর্জাতিক বাজার ও ফুলচাষ বিষয়ক আরও জানতে পড়ুন:
FAO on Floriculture
Chrysanthemum Growing Guide – RHS
উপসংহার
চন্দ্রমল্লিকা একটি লাভজনক, দৃষ্টিনন্দন ও চাহিদাসম্পন্ন ফুল। উপযুক্ত জাত নির্বাচন, আবহাওয়া বিবেচনা, জমি প্রস্তুতি এবং যত্নশীল পরিচর্যার মাধ্যমে একজন ফুলচাষি অল্প পরিশ্রমে প্রচুর লাভ করতে পারেন। বিশেষ করে যারা ছোট পরিসরে চাষ করতে চান বা বাড়ির উঠানে টবে ফুল চাষ করতে চান, তাদের জন্যও এটি আদর্শ একটি ফুল।