বায়োসিকিউরিটি বা জীবনিরাপত্তা। জীবনের জন্য সুরক্ষা। রোগজীবাণু মুক্ত রাখা। যে কোন খামারকে লাভজনক রাখতে হলে রোগ মুক্ত রাখাটা প্রথম শর্ত। জীব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অর্থ হল খামারের রোগ জীবাণুর প্রবেশ এবং বিস্তার বন্ধ রাখা। খামারে কোন ভাবে রোগের জীবাণু প্রবেশ এবং অবস্থান করতে না পারার ব্যবস্থাপনা হল বায়োসিকিউরিটি।
পোল্ট্রির খামার যেমন ভাল মানের বায়োসিকিউরিটি প্রয়োজন ঠিক একইভাবে ডেইরী খামারেও দরকার যথাযথ জীবনিরাপত্তা। দেশের বেশির ভাগ খামারে বিশেষত যারা প্রথমে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ ছাড়াই খামার করে থাকেন, সেই সব খামারে জীব নিরাপত্তা ততটা ভাল থাকে না। ডেইরী খামারে রোগ-জীবাণুর আক্রমণ থাকে অনেক বেশী। তাই উপযুক্ত বায়োসিকিউরিটির ঘাটতি হলে দুগ্ধবতী গাভী সহজে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে খামারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পাড়েন।
খামারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রোগ জীবাণু, প্রবেশ বিস্তার ইত্যাদি কমানোর যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া থাকে তাকে বায়োসিকিউরিটি বলে। ফার্ম প্রতিষ্ঠার সময়ের পরিকল্পনার শুরু থেকে সময়ের সাথে প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন পদক্ষেপ সবই বায়োসিকিউরিটির অংশ। ডেইরী খামার স্থাপনের সময় জীবনিরাপত্ত্বা নিশ্চিত করতে যে বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপুর্ণ তা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ
ফার্ম স্থাপনের সময় বিবেচ্য বিষয়ঃ
স্থান নির্বাচনঃ ডেইরী খামার লাভজনক রাখতে হলে খামারের অবস্থান এবং জায়গা নির্ধারণ করা গুরুত্বপুর্ণ। খামারের রোগ জীবাণু যেন বাতাসের মাধ্যমে অন্য কোন খামারকে আক্রান্ত করতে না পারে সেজন্য একটি খামার থেকে অপর আরেকটি খামারের দূরুত্ব কমপক্ষে ৩.২ কিলোমিটার হওয়া ভাল। লোকালয় থেকে একটু দূরে যেখানে যাতায়তের জন্য পাকা রাস্তা থাকে। কারণ খাবার আনা নেয়া, গরু নেয়া আনা সহ যে কোন কারণে ট্রাক বা অন্যান্য যানবহনের প্রয়োজন হয়। মুল রাস্তা থেকে একটু দূরে খামারের ভবন হওয়া উচিত। তবে পোল্ট্রির পরিবহনের জন্য আলাদা ছোট রাস্তা থাকতে হবে।খামারের জন্য পানির উৎসের পানিতে খনিজ লবনের পরিমাণ, ব্যাকটেরিয়াল এবং কেমিক্যাল কোন দুষণ আছে কিনা তা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করতে হবে। আলাদা আলাদা সময়ে যেমন বর্ষা ও শীতকালে এর কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তাও খেয়াল রাখতে হবে।
ফার্মের সীমানাঃ ফার্মের একটি নির্দিষ্ট সীমানা রাখতে হয় যেন অন্য বাইরের প্রাণি বা জীবজন্তু প্রবেশ করতে না পারে। এক্ষেত্রে সামর্থ অনুসারে সীমানাতে ইট বা বেড়া দেয়া যেতে পারে। অন্য খামারের গরু যেন খামারের গরুর সাথে মিশতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হয়। কুকুর, নিশাচর প্রাণি শিয়ালের প্রবেশ ঠেকাতে হবে। কারণ এরা অনেক রোগের জীবাণু বহণ করে থাকে। ভবনের গঠন এমন হতে হবে, যেন ভবনে বন্যপ্রাণী ও রডেন্ট প্রবেশ করতে না পারে। সংক্রামক রোগগুলো ছড়াতে এগুলো বাহকের ভুমিকা পালন করে।
বিভিন্ন বয়সের গরুর আলাদা আলাদা বাসস্থান নির্ধারণ করাঃ গাভি ও অন্যান্য গরুর জন্য আলাদা বাসস্থান রাখতে হবে। ছোট বাছুরের পরিচর্যার জন্য ঘর, বড় বাছুরের জন্য আলাদা এবং বকনা ও এঁড়ের জন্য থাকার স্বতন্ত্র স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।বর্তমানে অতি আধুনিক কিছু খামারে আলাদা ঘরের সাথে বেলকুনির মত আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এতে গরুর কিছুটা হাটাচলার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। ফলে একদিকে যেমন গরুর এক ঘেয়ামী দূর হয় অন্যদিকে পায়ের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
কোয়ারেনটাইন এর ব্যবস্থা রাখাঃ রোগের অন্যতম বাহক হিসাবে কাজ করে নতুন গরু। গরুর হাট বা কোন খামার থেকে গরু কিনে এনে সরাসরি খামারে প্রবেশ করানো যাবেনা। কারণ বাস্তবিক পক্ষে গরুটা সুস্থ্য মনে হলেও তার মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় কিছু রোগের জীবাণু থেকে যেতে পারে। এটাকে রোগের সুপ্তঅবস্থা হিসাবে ধরা হয়। তাই নতুন গরুকে খামারে অন্য গরুর সাথে না রেখে কোয়ারেনটাইন শেডে কমপক্ষে ১৫ দিন রাখতে হবে। এতে করে কোন রোগের জীবাণু থাকলে সেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে, প্রকাশ পেলে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করা যাবে। অন্যথায় সুস্থ্য গরুতে ঐ রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।কোয়ারানটাইন অবস্থায় রাখাকালে গরুকে খাবার ও পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখতে হবে। তবে আরো সতর্কতা স্বরূপ আলাদা আলাদা খাবার ও পানির পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। নতুন গরুর পায়ে পটাশিয়াম পার মাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে মাঝে মাঝে পরিষ্কার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।এই ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালনা করলে হঠাৎ করে রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব।
অসুস্থ্য প্রাণি রাখার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করাঃ গরুর অসুস্থ্যতার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে সুস্থ্য গরুদের থেকে আলাদা করতে হবে। অসুস্থ্য শেডে চিকিৎসা সতায়তার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন স্যালাইন দেয়ার সুবিধার জন্য স্যালাইন স্টান্ড সহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা রাখা ভাল। অসুস্থ্য গরুকে যত দ্রুত সম্ভব আলাদা করতে হবে, এতে করে অন্য প্রাণিতে রোগ ছড়ানোর হাত থেকে রক্ষা পাবে। বায়োসিকিউরিটি নিয়িন্ত্রণের জন্য এই ব্যবস্থাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
খাদ্য রাখার সংস্থা উন্নত করে রাখাঃ দানাদার এবং খড়জাতীয় উভয় প্রকার খাবার রাখার ব্যবস্থা হতে হবে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে। রাখার স্থান পাকার হলে ভাল। এখানে যেন ইদুর, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি আসতে ও থাকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। নাহলে এদের বিষ্ঠা ও জীবাণূ গরুর রোগ সৃষ্টির কারণ হতে পারে। দানাদার খাদ্যকে বায়ুরোধী পাত্রে রাখলে খাদ্যের মান ও গুণাগুণ ভাল থাকে। ঘড়গুলোকে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
বাচ্চা প্রসবের সময়ের জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করাঃ বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে গাভী খুব নাজুক অবস্থায় থাকে। ঐ সুযোগে কিছু রোগের জীবাণু তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। তাই ঐ সময়ে গাভীর জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের প্রয়োজন। মোটামোটি খড় বিছিয়ে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ঐ সময়ে শেডের চারপাশ ভালভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে। বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে গাভী এফএমডি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। খামারে ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থেকে থাকে। ঐ সময়ে গাভীর জন্য পরিষ্কার পানি এবং খাবার সরবরাহ করতে হবে। বাচ্চাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, না হলে ঔ সময়ে বাচ্চার নাভী কাঁচা থাকে বলে জীবাণুর আক্রমণে সহজে নাভীপাকা রোগের আক্রান্ত হতে পারে। শীতকালে বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।
পয়ঃনিষ্কাশনঃ খামারকে রোগমুক্ত রাখতে ড্রেইনেজ বা পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত রাখতে হবে। ফার্মের ডিজাইন বা গঠনে বৃষ্টির পানি এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহৃত পানির আলাদা ডিসপোজাল ব্যবস্থা রাখতে হয়। এটা জৈব নিরাপত্তা এবং পরিবেশের নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।গরুর গোবর রাখার জন্য নির্দিষ্ট দুরুত্বে ম্যানুউর পিট বা গর্ত করে গোবর জমা রাখলে পরবর্তীতে তা দিয়ে বায়োগ্যাস এবং জমিতে জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু যেন খামারের দিকে না আসে সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
প্রবেশাধিকার সংরক্ষণঃ খামারের দর্শকের সংখ্যা কমাতে হয়। মানুষের পোষাকের মাধ্যমেও কিছু জীবাণু ফার্মে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে ফার্মের বাইরে প্রবেশ নিষেধ বা প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত লিখে রাখতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে খামারে ঢুকতে দেয়া যাবেনা। যারা যাবে তাদেরকে যতটা সম্ভব জীবাণুমুক্ত করে প্রবেশ করাতে হবে।
কর্মচারীদের আলাদা পোষাকঃ খামারের কর্মচারীদের জন্য আলাদা পোষাকের ব্যবস্থা করা ভাল। ফার্মে প্রবেশের পূর্বে সে পোষাক পরিধান করে আবার কাজ শেষে পরিষ্কার করতে হবে। এতে করে পোষাকের মাধ্যমে রোগ জীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যাবে। নিয়মিত ধোলাই করার মাধ্যমে পোষাককে জীবাণুমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
ফুট ওয়ার বাথ ব্যবহারঃ খামারে প্রবেশের মুখেই জীবাণু নাশক ছিটিয়ে ফুট ওয়ার বাথের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ফার্মে প্রবেশের পূর্বে জুতা সেই বাথে ডুবিয়ে যেতে হবে। তাহলে পায়ের তলায় কোন জীবাণু থাকলে তা আর খামারে প্রবেশ করতে পারবেনা। একই ভাবে গাড়ী প্রবেশের সময়ও সেই বাথের উপর দিয়ে চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। উপযুক্ত জীবাণুনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়।
শেড জীবাণুমুক্ত করাঃ সপ্তাহে কমপক্ষে এক বার করে শেডের চারপাশ পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। গরু রাখার স্থানে ব্লিচিং পাউডার বা শক্তিশালী জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। ফ্লোর যত পরিষ্কার থাকবে গাভীর ওলান তত ভাল থাকবে। ম্যাসটাইটিস রোগের প্রকোপ কমবে। তাই নিয়মিত ফ্লোর জীবানুমুক্ত রাখলে গাভী সুস্থ্য ও নিরোগ থাকবে।
দুধ দোহানোর পুর্বে পরিচ্ছন্নতাঃ ডেইরী খামারের আরেকটা বড় করণীয় হল পরিচ্ছন্নতার সহিত দুধ দোহানো। দুধ দোহানোর পূর্বে গোয়ালার হাত ভালভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে সুতির কাপড়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ওলান মুছে নিতে হবে। কারণ ওলান প্রদহের প্রধান কারণই হল দোহানোর সময় জীবাণুর সংস্পর্শ বা অনুপ্রবেশ। এই সময় জীবাণুমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে গাভীর ম্যাসটাইটিস হওয়ার সম্ভবনা প্রায় থাকেনা বললেই চলে। দুধ উৎপাদনও ঠিক থাকে।