
বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সৃষ্ট সুন্দরবনটার অবয়ব হলো কোথাও ঢালু, আবার কোথাও সমান জায়গা। এখানকার সম্পদ সমৃদ্ধির একমাত্র উপযোগ হলো জোয়ার এবং ভাটায় জল আসা ও যাওয়া। ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে আছে ৪৫০ টি নদী ও খাল। যার আয়তন হলো ১৮০৫ বর্গ কিলোমিটার। বন, জল এবং তা থেকে উৎপাদিত সামগ্রি আহরণকে ঘিরে। এই বনে যে জল আছে তার উপরে নির্ভর করে বেঁচে আছে সবচেয়ে বেশি মানুষ। সার্বক্ষনিক কাজের নিশ্চয়তা আসে এই জল ও জলজ সম্পদকে ঘিরে। এখানে মৌসুমী মৎস্য আহরণের চর আছে ১১ টি। নিষিদ্ধ খাল আছে ১৮ টি। সব মিলিয়ে যে জলের সমারোহ তা থেকে আসে মাৎস্য সম্পদ। এই সম্পদকে নিয়ে ১.৫ লাখ জেলে এবং তাদের পরিবার পরিজনের আহারসহ জীবন পরিচালিত হয়। সুন্দরবনের জলে ব্যবহৃত হয় ১৬ রকমের জাল। যে জালে যেমন মৎস্য আহরিত হয় আবার এই জালের কারণে ধংস হয় মাৎস্য সম্পদও। মাৎস্য সম্পদ উৎপাদন ও বিচরণের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের একটা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট আছে। তার মধ্যে বলা চলে এই বনের জলে লালন পালন হয় বাগদা এবং গলদা চিংড়ির পোনা। বনের জলে সাক্ষাৎ মেলে নানা প্রজাতির লবণ জলের মাছ। এছাড়া কচ্ছপ, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ও চিংড়ির প্রাকৃতিক প্রজননের অভয় এলাকা হিসেবে। সুন্দরবনের জলে ইলিশের বিচরন যেমন স্বাভাবিক এক নিয়মে, আবার এখানে এসে মাছ প্লাংটন সমৃদ্ধ জলরাশি বিশেষ করে এই সুন্দরবন এলাকা হয়ে দিন দিন পশুর, শিবসা,বলেশ্বর, রূপসা, যমুনা, মেঘনা, পদ্মা হয়ে ফারাক্কা বাঁধের আগ পর্যন্ত এবং মধুমতি, গড়াই প্রভৃতি নদীতে উঠে আসে। ইলিশ সব সময়ে প্লাংটন ভোজি। এই মাছের অভ্যাসগত খাদ্যের মধ্যে রয়েছে প্রোটোজোয়া ১.২২ শতকরা, এ্যালজি ৪১.৬৫ শতকরা, ডায়াটম ১৫.৩৬ শতকরা, ক্রাস্টাসিয়া ১.৮৯ শতকরা। এই উপাদানগুলো বনের জলে সমৃদ্ধ থাকে। তবে সমুদ্র হতে ইলিশ যত উপরে উঠে আসে সে তত দু:খ-কষ্ট এবং জীবন ঝুঁকিতে পতিত হয়। সমুদ্র থেকে নদীর উজান মুখে যত এগিয়ে আসা যাবে তত কমবে খাবার, গভীরতা, স্রোত এবং তাপমাত্রা। সে ক্ষেত্রে সুন্দরবন হলো ইলিশের স্বাচ্ছন্দ্যময় বাসস্থান। বনের জলে ভেসে আসে ২০৬ প্রজাতির সাদা মাছ। তারমধ্যে ভেটকি, রূপচান্দা, লইট্যা, তাপসী, খরশোলা, পারসে, পোয়া উলেখযোগ্য। এই বনের জলে ১৪ গোত্রের ৪২ রকমের মালাস্কা পাওয়া যায়। এখানে আছে ইরাবতী ও গাঙ্গেয় ডলফিন। আছে গভীর লবণ জলের ২৭ গোত্রের প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ। যেমন হাঙ্গর ও শাপলা পাতা মাছ। সুন্দরবনের বিষেশায়িত ৫ গোত্রের ২৬ প্রজাতির চিংড়ি দেশের জন্য আশির্বাদ। তারমধ্যে গলদা, বাগদা, বাঘতারা, হরিণা, চাগা উলেখযোগ্য। ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া যেমন লাল কাঁকড়া, শীলা কাঁকড়া, ঝাঁজি কাঁকড়া আর ৩ প্রজাতির কচ্ছপ বনের আকর্ষণকে আরো ঔজ্বল্যতা ছড়িয়েছে। প্রতি বছর মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে গড়ে আয় হয় ৫-৭ কোটি টাকা। এই বনের উপর নির্ভর করে জীবন পরিচালিত করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ লাখ পরিবার। মধু আহরিত হয় বছরে ১৫-১৬ হাজার মণ। বছরে জেলেরা বনের জল হতে আহরণ করেন ১৫-২০ হাজার মে.টন সাদা মাছ। ৪ হাজার মে.টন চিংড়ি ও কাঁকড়া। ইলিশ প্রায় ৮০০ মে.টন।
গলদা বা বাগদার পোষ্ট লার্ভা (পি এল)সহ অন্যান্য মাছ আহরণ করতে জলের মধ্যে চাঁদরেরমত নিষিদ্ধ জাল বিছিয়ে, এই জাল দিয়ে জলের তল দেশ হতে নরম পলি আস্তরণ সমেৎ উপরে টেনে তুলে প্রয়োজন মেটাচ্ছে জেলেরা। এরা এই সামান্য প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে ঐ কাঁদা সমেৎ বিশাল সংখ্যক জলজ প্রাণী এবং জু-প্লাংটন হত্যা করে নির্বংশ করছে জলজ প্রাণিকূলকে। তাদের কাছে যেটা ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টাংশ তা কিন্তু আগামীর জন্য জাতির বড় প্রয়োজনীয় এক মহা মূল্যবান উপাদান। যা হরহামেশা নষ্ট করে দেয়া হলেও এটা রক্ষায় দেখভালের কেউ না থাকায় দেশ হারাচ্ছে আগামীর অবধারিত ও সম্ভাবনাময় সম্পদ। এই জন্য ক্রমে ক্রমে অনেক জলজ প্রাণি অস্তিত্বের মহাশংকটের তালিকায় জায়গা করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান বলছে নরম পলি নিংড়ে একটা পিএল ধরতে গিয়ে আমরা হারাচ্ছি ২১৪ রকমের অন্যান্য জলজ প্রাণি এবং জু-প্লাংটন। ১ ঃ ২১৪ অনুপাতে বছরে আমরা কত রকমের জলজ প্রাণি এবং সম্পদকে নির্বোধের মত নষ্ট করছি তা কি কখনও ভেবে দেখেছি ? প্রয়োজনেরটা রেখে লোনা কাদাটা যদি আবার জলে ফেলে দেওয়া যায় তবে আমাদের জলজ প্রাণি জীবন রক্ষা পেয়ে জলজ সম্পদকে আরো সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী করতে পারতো। আমাদের দেশে ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে খাল কেটে, নদী বেঁধে, পাড় তৈরী করতে গিয়ে যে ভাবে মিষ্টি জলের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করেছি, তারচেয়েও ভয়াবহ অবস্থায় আজ পলি নিংড়ানো ধানি-পোনা ধরতে গিয়ে জলের আশির্বাদ অবশিষ্ট সম্পদ নষ্ট করছি। সুন্দরবনে কারেন্ট জাল, মশারী জাল, টানা জাল, খুরচি জাল, চরপাটা জাল, হাঙ্গর জাল, কাঠি জাল, টানা জাল, রকেট জাল, দোন দড়ি, সূতি জাল, গুষ্টিমারা জাল,নেট জাল নামে বিভিন্ন রকমের জাল ব্যবহার করা হয়। যে জালে একটা মাত্র পোনা ধরতে গিয়ে শুধু অন্য পোনা মারা যাচ্ছে ৭০ প্রজাতির মাছের। সাথে অন্যান্য প্রাণিতো রয়েছেই। বনের নদী ও খালের জলে আমাদের মাৎস্য সমৃদ্ধ এখন এমন এক হুমকি মোকাবেলা করে টিকে আছে। হাজার হাজার জেলে প্রতিদিন এই জাল ব্যবহার করে এই সম্পদকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মহা সংকটের তালিকার দিকে। জাটকা থেকে ইলিশ, রেণু থেকে পোণা, পিএল থেকে চিংড়ি পোনা কিংবা অন্যান্য পোনা ধরতে সমগ্র জলে যে চাঁদরের মত জাল ব্যবহার করা হয়, তাতে কোন জলজ প্রাণি ঘাড় ঘুরিয়ে নড়চড়ও করতে পারেনা। অথচ এদের রক্ষায় আইন আছে। প্রশাসন আছে। আছে লোকবল ও আদালত। তারপরেও ঠেকানো যাচ্ছেনা আমাদের মাৎস্য এই সম্পদকে। দিন দিন যেমন পালা দিয়ে চাহিদা বাড়ছে তারচেয়ে আরো গতিতে কমছে আমাদের রিসোর্স ও উৎপাদন। সহজ আমিষ যোগানের এই সরবরাহ খাতকে রক্ষা করা না গেলে দেশে এই খাতে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নামবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিশাল জনগোষ্ঠির প্রতিদিনের আমিষ যোগানের সহজ সোর্স হিসেবে খ্যাত, মৎস্য চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আবার উৎপাদনের রিসোর্স কমছে দ্রুত গতিতে। ফলে একেতো অল্প জলে অধিক উৎপাদনের জন্য চাপ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যদি ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টাংশ অথচ প্রয়োজনীয় উপাদানকে বড় হওয়ার সুযোগ না দিয়ে এভাবে নি:শেষ করে দেওয়া হয় তবে তা জাতির জন্য মহা বিপদ সংকেত ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। সুতরাং এখনই অবৈধ জাল রুখতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করতে হবে চট জালসহ ক্ষতিকর সকল জালের ব্যবহার। সুন্দরবনের জলে চিংড়ি ধরা বন্ধ করতেই হবে। তা নাহলে আমাদের জলজ সম্পদের বিরাজমান প্রাণির বিপন্ন তালিকা দ্রুত দীর্ঘ হবে। মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র বনের সম্পদকে রক্ষা করা গেলে নিমেষেই টিকবে কালের ঐতিহ্য ও সম্পদের সমারোহ সুন্দরবন। নচেৎ দিনে দিনে তা হারিয়ে যাবে আমাদের অস্তিতেরও আঙিনা থেকে।
লেখক ঃ গবেষক, উদ্ভাবক (জৈব বালাই নাশক),
পরিবেশ ব্যক্তিত্ব ও পদক বিজয়ী প্রাবন্ধিক। ক্স