
শাকসবজি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যের একটি অন্যতম প্রধান অংশ। আহারে বৈচিত্র্য আনা ছাড়াও শাক-সবজি পুষ্টির দিক দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে লালশাক, পালং শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো,বেগুন ও গাঁজর অন্যতম। ভিটামিনের প্রাচুর্যতা থাকায় শাক-সবজি দেহের স্বাভাবিক পুষ্টির কাজ স¤ন্ন করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে অপুষ্টির হাত হতে রক্ষা করে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক প্রায় ২৫০- ৩০০ গ্রাম শাক-সব্জি খাওয়া উচিত। এক হিসেবে দেখা যায় বাংলদেশের লোক গড়ে শাক-সব্জি খায় ৩১ গ্রামের মতো। যেখানে উন্নত বিশ্বের জনগণ মাথাপিছু দৈনিক শাক-সব্জি খেয়ে থাকে ৩০০-৩৫০ গ্রাম।
আামাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য প্রত্যহ শাক সব্জি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলা উচিত। ভিটামিন এ এর অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ শিশু রাত কানা রোগে আক্রান্ত হয়। অথচ আমরা শুধু শাক সব্জি খেয়েই এই রাতকানা রোগ থেকে আমাদের শিশুদের রক্ষা করতে পারি। শীত কালে আমাদের দেশে নানারকমের তাজা শাক সব্জি খুবই অল্প দামে পাওয়া যায়। তাই এই শাক সব্জি খেয়ে আমারা আমাদের পুষ্টিহীনতা দুর করার পাশাপাশি ভাতের উপরও চাপ কমাতে পারি। শীতকালীন শাক-সবজি অতি প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাদ্য। এতে মানব দেহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, আয়োডিন প্রভৃতিসহ দেহের অনেক প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ রয়েছে। তাছাড়া শাক-সবজি থেকে কিছু পরিমাণে স্নেহ পদার্থ এবং যথেষ্ট পরিমাণে শর্করা জাতীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। যেমন জনপ্রিয় একটি সব্জি বাঁধাকপির খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্যশক্তির পরিমাণ ২৬ কিলোক্যালরী। আবার অন্যদিকে আরেকটি লোভনীয় শীতের সব্জি ফুলকপির খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্যশক্তির পরিমাণ হলো ৪১ কিলোক্যালরী । একই ভাবে লাল শাক ও পালংশাক এর খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্যশক্তির পরিমাণ হলো যথাক্রমে ৪৩ কিলোক্যালরি এবং ৩০ কিলোক্যালরি। লালশাক, পালংশাক, ফুলকপি ও বাঁধাকপি ভিটামিন ‘সি’-এর উৎকৃষ্ট উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম লালশাক এবং পালংশাক এ ভিটামিন সি এর পরিমাণ যথাক্রমে ৪৩ মিলিগ্রাম ও ৯৭ মিলিগ্রাম। একই ভাবে বাধাঁকপি ও ফুলকপিতে ভিটামিন সি এর পরিমাণ যথাক্রমে ৩০ মাইক্রোগ্রাম ও ৯১ মিলিগ্রাম। তাই বাঁধাকপির সবুজ পাতা সিদ্ধ না করে সালাদে খাওয়া যেতে পারে। কারণ সিদ্ধ করলে ভিটামিন ‘সি’ নষ্ট হয়ে যায়। বাঁধাকপি ও ফুলকপিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ, ম্যাগনেশিয়াম, ফোলেট, ভিটামিন বি৬, পটাশিয়াম এবং ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড। লালশাক ও পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন । যেহেতু এখন বাজারে শীতের সবজি হিসেবে লালশাক, পালংশাক ,বাঁধাকপি এবং ফুলকপি সর্বত্রই পাওয়া যায়, তাই নিয়মিত খাদ্য তালিকায় এই শাক-সব্জির স্থান বাঞ্ছনীয়।
পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি শাক-সবজি দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরের চাহিদামত শীতকালীন শাক-সবজি খেলে নানা রকম রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং শরীর সুস্থ থাকে। গবেষনায় দেখা গেছে, শাক-সবজি খাওয়ার ফলে ক্যান্সার, কিডনী রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় ঝুঁকি অনেক কম। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি খেয়ে থাকে, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশংকাও কমে যায়। শীতকালীন শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে। এই আঁশ খাদ্য দ্রব্য হজম, পরিপাক ও বিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। শাক-সবজিতে বিদ্যমান আঁশ মলাশয়ের ক্যান্সার, বহুমুত্র, স্থূলকায়ত্ব, হৃৎপিন্ড, রক্তচাপ, মূত্রনালীর পাথর ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ট কাঠিন্য দূর করে দেহকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। তাছাড়া শীতকালীন শাক-সবজি শিশুদের অপুষ্টিজনিত রাতকানা, অন্ধত্ব, রিকেট, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ, স্কার্ভি, মুখ ও ঠোঁটের কোণে ঘা, রক্তশূন্যতা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, অপুষ্টি ও দেহের রোগ প্রতিরোধে শীতকালীন শাক-সবজির ভূমিকা অপরিসীম।
শাক-সব্জিতে বিদ্যমান খনিজ উপাদানগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে এবং দেহকোষ থেকে ক্ষতিকর মুক্তযৌগ অপসারণ করে রোগ প্রতিরোধ সহায়ক হিসাবে কাজ করে । অথচ সবজির খাওয়ার গুরুত্ব না দিয়ে আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ভিটামিন এবং ফুড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করি। গবেষকদের মতে শাক-সবজিতে কয়েক হাজার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ঔষধ বা ড্রাগ হিসাবে ব্যবহৃত একক বা মাত্র কয়েকটি ভিটামিন গ্রহণের চেয়ে অধিকতর কার্যকর ভ‚মিকা রাখে। ক্যান্সার, হৃদরোগ ইত্যাদি জটিল রোগেরও ঝুঁকি কমতে পারে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে রকমারি শাক-সবজি খাওয়া যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে জানা যায় নিরামিষ গ্রহণে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। বিটাক্যারোটিন, ভিটামিন ‘সি’ ‘ই’ এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ খাবার ম্যাকুলার ক্ষয় থেকে চোখকে রক্ষা করে দৃষ্টিশক্তি অক্ষুণœ রাখতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক তথ্যে জানা যায় ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার আলঝিমার’স রোগের ঝুঁকি কমায়। আমাদের দেশের অনেক মহিলাই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই বাঁধাকপি এবং ফুলকপি স্তন ক্যান্সারের প্রতিরোধে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। বাঁধাকপি এবং ফুলকপি মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন বাড়ায়, যা হরমোনজনিত ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। নেদারল্যান্ডে এক লাখ মানুষের উপর ছয় বছরব্যাপী জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, যারা মাঝে মাঝে এসব সবজি খেয়েছেন তাদের ২৫% ক্যান্সারের ঝুঁকি কমেছে। আর যারা নিয়মিত খেয়েছেন তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪৯% কমেছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে মহিলাদের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, যারা এই সবজি খেয়েছেন তাদের ফুসফুসের ক্যান্সার ৩০% কমেছে আর যারা ধূমপায়ী তাদের ক্ষেত্রে শাক-সব্জি খেয়ে ৬৯% সুফল পেয়েছে। জানা যায় যে, প্রতিদিন নিয়মিতভাবে বাঁধাকপির রস পান করলে আলসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। শাক-সব্জিতে প্রচুর আঁশ থাকায় হৃদরোগ ও কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করে। পাশাপাশি শাক-সব্জিতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন থাকায় হৃৎপিন্ডের জন্য খুব উপকারী। কারণ শাক সব্জিতে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড এবং কোলেষ্টেরল পরিমাণে অনেক কম থাকে। তাই হৃৎরোগীদের জন্যও এসব শীতকালীন শাক সব্জি উপকারী।
আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিকাল নিউট্রিশন সম্প্রতি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য নিয়ে গবেষণা করে একটি খাদ্য তালিকা তৈরি করেছে। এই খাদ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে গাজর, আলু, টমেটো, ব্রকলী, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, মরিচ, অ্যাসপ্যারাগাস ও মাশরুম। তারা পরীক্ষা করে দেখেছে সেদ্ধ বা রান্না করলেও এসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কার্যকারিতা হ্রাস পায় না। তবে কোনো কোনো সব্জির (শসা, গাজর ইত্যাদি) খোসা ফেলে দিলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পায়। প্রকৃতপক্ষে সুস্থ ও নিরোগ থাকার জন্য এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য শুধু সাপ্লিমেন্টারী খাদ্য এবং হাইপটেন্সি ভিটামিন এর প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এসব সহজলভ্য শীত কালীন শাক-সব্জির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।