
পরিচিতিঃ পোল্ট্রির মধ্যে রাজহাঁসই মানুষ প্রথম পালন করে। সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও মাংসের জন্য পালন করা হয়। এদের ঘাড় লম্বা, মুখে লোম এবং পা জালিকাকার। রাজহাঁস ২০ থেকে ৬০ বছর বাঁচে। ৯৬ টি জাত রয়েছে। প্রধান জাত ২টি। এদের স্মরণ শক্তি খুব বেশি ও চালাক। যে কোন বিষয় খুব দ্রুত শেখে। এরা ঋতুভিত্তিক ডিম পাড়ে। পুরুষ রাজহাঁস প্রজনন ঋতুতে আক্রমণাত্মক হয়। রাজহাঁস কামড়ায় এবং পাখনা দিয়ে জোড়ে আঘাত করে। তিন বছরে প্রজনন সক্ষম হয়। পুরুষ ও স্ত্রী রাজহাঁসের মধ্যে সম্পর্ক খুব দৃঢ়। জোড়া ভাঙা খুবই কষ্টসাধ্য। বসন্তকালে প্রজননের সময় ছাড়া সবসময় দলবদ্ধভাবে চলে। এরা ঘাস খায়। খুব কষ্ট সহিষ্ণু। অল্প পানিতে জীবন ধারণ ও প্রজনন করতে পারে। পরিবেশের সাথে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে। ৪ – ৬ টি স্ত্রী রাজহাঁস একটি পুরুষ রাজহাঁস দিয়ে প্রজনন করানো যায়।
রাজহাঁস পালনের গুরুত্বঃ
১. পোল্ট্রির মধ্যে রাজহাঁস সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। ১০ সপ্তাহে ৫ কেজির বেশি ওজন হয়।
২. বিছানা ও পোশাক তৈরিতে এর নরম পালক ব্যবহার হয়।
৩. এরা ঘাস খায় বলে সম্পূরক খাদ্য কম লাগে।
৪. ঠান্ডা গরম সব আবহাওয়াতে খাপ খাওয়াতে পারে।
৫. রাজহাঁস ফসলের জমির আগাছা খেয়ে পা দিয়ে মাটি নিড়ানির কাজ করে।
৬. কম মূলধনেও পালন করা যায়।
৭. বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাজহাঁস পালন করা যায়।
৮. বাসা বাড়ি পাহারার কাজ করে। অপরিচিত কেউ আসলে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে ও কামড়াতে চায়।
৯. উৎপাদন খরচ কম বলে পালন করে লাভবান হওয়া যায়।
১০. ঘাস লতাপাতা খেয়ে বাড়ি ঘর পরিষ্কার রাখে।
পাতি হাঁসের চেয়ে রাজহাঁস পালন কিছুটা ভিন্ন রকম। নিচে রাজহাঁস পালন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলোঃ
আবাসস্থলঃ
রাজহাঁসের ঘর খোলা-মেলা বায়ুচলাচল করে এমন স্থানে তৈরি করতে হবে। একটি রাজহাঁসের জন্য ৩ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন। ঘরের উচ্চতা ২ মিটার, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হাঁসের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। ছাউনি টিনের এবং বেড়া মোটা তারের দিতে হয়। ঘরের একদিকে দরজা রাখতে হবে। এটা হচ্ছে আবদ্ধ পদ্ধতি। মেঝেতে ডিপ লিটার পদ্ধতিতে ১৫ সে.মি. পুরু করে কাঠের গুঁড়ো, ভুসি, বালু ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। লিটার সবসময় শুকনো রাখতে হবে। মুক্ত পদ্ধতিতে শুধু রাতে ঘরে থাকে এবং সারাদিন বাহিরে বা চারণভূমিতে থাকে। ঘরের ভিতর এবং বাইরে তিনটি হাঁসের জন্য ১ বর্গমিটারের একটি করে ডিম পাড়ার বাক্স দিতে হবে। পানি ও খাবার পাত্র পৃথক দিতে হবে। চারণ ভূমিতে পালন করলে প্রতিটি রাজহাঁসের জন্য ১৫-৩০ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন।
বাচ্চা পালনঃ
ইনকিউবেটরে ফুটানো বাচ্চাকে নির্দিষ্ট তাপে রাখতে হয়। বাচ্চার প্রথম সপ্তাহ বয়সে তাপমাত্রা ৩০ক্কসে. থাকা উচিত। এরপরে প্রতি সপ্তাহে ৫ক্কসে. তাপ কমিয়ে ঘরের তাপমাত্রায় আনতে হয়। প্রথম তিন দিন বাচ্চাদের ধরে খাওয়াতে হয়। ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ১ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন।
হাঁসের বাচ্চাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিষ্কার পানি ও সুষম খাদ্য দিতে হয়। প্রতি ব্রæডারে ৩-৪টি পানির পাত্র এবং ৩-৪টি খাদ্যের থালা দিতে হবে। এক সপ্তাহ পর খাদ্যের থালা সরিয়ে ছোট আকারের খাদ্য পাত্রে খাদ্য দিতে হবে।
খাদ্যঃ
রাজহাঁসের দ্রুত বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সম্পূরক বা সুষম খাদ্য খাওয়ানো উচিত। নিচে সুষম খাদ্য উপাদানের তালিকা দেয়া হলো :
এ খাদ্য উপাদানগুলো গুঁড়ো করে মিশিয়ে সুষম খাদ্য তৈরি করা হয়। রাজহাঁস চারণভূমিতে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ৯ কেজি খাবার খায়। ১৬ সপ্তাহে ৩ কেজি খাদ্য খেয়ে ২ কেজি মাংস উৎপাদন করে। খাদ্যের পাশাপাশি পানি দিতে হয়। দিনে তিন বার খাদ্য দিতে হয়। প্রজননের আগে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৬৫-১৭০ গ্রাম সুষম খাদ্য দিতে হয়।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
রাজহাঁসের রোগ কম হয়। রক্ত আমাশয়, কলেরা, কোরাইজা ইত্যাদি রোগ হয়। রক্ত আমাশয় ও কলেরা হাঁসের ও মুরগির রোগের মতই। এসব রোগ দমনের জন্য জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। নিয়মিত টিকা দিতে হবে। সুস্থ ও অসুস্থ রাজহাঁস পৃথক করতে হবে। রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেলে মৃত রাজহাঁস মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। খাদ্য পাত্র ও পানির পাত্র পরিষ্কার রাখতে হবে। বাইরের কোন লোক রাজহাঁসের নিকট যেতে দেয়া যাবে না। অতিথি পাখি বা অন্য পাখির কাছে রাজহাঁসকে যেতে দেয়া যাবে না। সুষম টাটকা খাবার খাওয়াতে হবে।
লেখকঃ কৃষি সাংবাদিক এবং সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল।