কৃষিবনায়ন কি?
কৃষিবনায়ন হচ্ছে এমন একটি সাসটেইনেবল ভূমি ব্যাবস্থাপনা যা ভূমির সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি করে; যুগপৎ বা পর্যায়ক্রমিকভাবে কৃষিজাত ফসল, বৃক্ষজাত ফসল ও বনজ উদ্ভিদ এবং/অথবা পশুপাখীকে একত্রিত/সমন্বিত করে এবং সেই সব পরিচর্যা পদ্ধতি অবলম্বন করে যা ঐ নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতির ধ্যান-ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ (Bene et al. ১৯৭৭)। আবার Nair (১৯৭৯) এর মতে কৃষিবনায়ন হচ্ছে একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেখানে বৃক্ষ, ফসল এবং পশু পাখীকে এমনভাবে সমন্বয়/একত্রিত করা হয় যেটা বৈজ্ঞানিকভাবে নিখুঁত হয়, পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, ব্যবহারিক দিক থেকে সম্ভাব্য হয় এবং সামাজিক দিক থেকে কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
উপরে বর্ণিত সংজ্ঞাসমূহকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে –
ক) কৃষিবনায়নে দুই বা ততোধিক ফসল থাকবে যার মধ্যে অন্ততঃ একটি ফসল হতে হবে বহুবর্ষজীবি কাষ্ঠল উদ্ভিদ।
খ) কৃষিবনায়ন ধারা থেকে দুই বা ততোধিক উৎপাদন অথবা উপকারীতা বেরিয়ে আসবে।
গ) কৃষিবনায়ন ধারা পরিবেশগত (কাঠামো এবং কার্যকারিতার দিক থেকে) এবং অর্থনৈতিকভাবে একক চাষাবাদ অপেক্ষা অধিকতর জটিল এবং লাভজনক।
কৃষিবনায়ন নিম্নের তিনটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে-
১) বৃক্ষ ও অন্যান্য বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ
২) মৌসুমী অথবা একবর্ষজীবী কৃষিজাত উদ্ভিদ/ফসল
৩) পশু পাখী ও মৎস্য
উপরোক্ত তিনটি উপাদানের সব ক’টি অথবা যে কোন দু’টি উপাদানের সংমিশ্রণে/সমন্বয়ে একটি কৃষিবনায়ন ধারা গড়ে উঠতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, যে কোন কৃষিবনায়ন ধারার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে বৃক্ষ বা কাষ্ঠল বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ যা বহুবিধ ব্যবহারযোগ্য।
উপকারিতা
১) কৃষিবনায়নে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চত হয়।
২) একই জমি থেকে একই সাথে ফসল, শাকসবজি, পশুখাদ্য, জৈবসার, কাঠ, ফল, মাছ, গোশত, ডিম, দুধ ইত্যাদি উৎপাদন সম্ভব।
৩) কৃষি বনায়নের ফলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণ উন্নত হয়।
৪) একক চাষাবাদ এর শস্যহানির ঝুঁকি কমে যায়।
৫) ফসল, বৃক্ষ, পশুপাখি ও মাছের আন্তঃক্রিয়ায় পরষ্পর উপকৃত হয়।
৬) প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ঘর-বাড়ী ও ফসল রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৭) বেকারত্ব দূরীকরণ ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হয়।
৮) সর্বোপরি বসতবাড়ীর প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর হয় এবং পরিবেশ উন্নত হয়।
সীমাবদ্ধতা
১) অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ ও ফসল একসাথে চাষাবাদ করলে উহাদের মধ্যে স্থান, সূর্যরশ্মি, পানি ও পুষ্টি নিয়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে এবং এতে ফলন কম হবে। তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এনে বৃক্ষ ও ফসল নির্বাচন করতে হবে।
২) বৃক্ষ ও ফসলের রোগবালাই পরস্পরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৩) সেচের পরিমাণ বেশি লাগবে।
৪) গাছ কাটার সময় ফসল এবং অন্যান্য উদ্ভিদের ক্ষতি সাধন হতে পারে।
৫) জমি চাষ ও ফসল পরিচর্যায় অসুবিধা হয়।
৬) শ্রমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
৭) পরিকল্পিত কৃষিবনায়নে জনগণের জ্ঞান বৃদ্ধি এক বড় চ্যালেঞ্জ।
বসতবাড়ীর কৃষিবনায়ন
বসতবাড়ীর কৃষিবনায়ন হলো কৃষিবনায়নের একটি ধারা, যেখানে বসত বাড়ীর নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, শোভা বর্ধনকারী বৃক্ষ, অন্যান্য উদ্ভিদ, বৃক্ষ ফসল, উদ্ভিদ ফসল, গবাদী পশু, হাঁস-মুরগী, মৎস্য ইত্যাদির সমন্বয়ে সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠে যা কৃষিবনায়নের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত এবং প্রাচীন উদাহরণ। এটি আবার জীবন নির্বাহ কৃষিবনায়ন ধারাও বটে। এই ধারার মূল লক্ষ্য হতে পারে পরিবারের মৌলিক চাহিদা সমূহ পূরণ করা। সাধারণত ক্ষুদ্র ও দরিদ্র বা স্বল্প সামর্থযুক্ত পরিবার সমূহ পারিবারিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ধারা হতে বেশি উপকৃত হতে পারে।
একটি আদশ বসতবাড়ীর কৃষিবনায়ন ধারার গঠন
প্রায় প্রতিটি বসতবাড়ীতে কৃষিবনায়নের অস্তিত্ত¡ থাকলেও যথাযথ পরিকলপনার অভাবে তা থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। ফলে ধারণাটি পুরাতন হলেও মানুষ এটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। অথচ পরিকল্পনামাফিক বসতবাড়ীতে কৃষিবনায়নের মাধ্যমে একটি পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব। একটি আদর্শ বসত বাড়ীরর কৃষিবনায়ন ধারা গড়ে তোলার জন্য নিম্নলিখিত প্রধান দিকগুলো বিবেচনায় রাখতে হবেঃ
১) বসতবাড়ীর চারপাশের সীমানায় বেড়া হিসেবে মান্দার, ভেরেন্ডা, পলাশ, জিগা ইত্যাদি উদ্ভিদ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বসতবাড়ীর সীমানা নির্ধারণ ছাড়াও সুরক্ষার কাজও করবে।
২) বাড়ীর আঙ্গনায় শাক-সবজীর চাষ করতে হবে।
৩) বসতবাড়ির আঙিনার ফাঁকা স্থানে- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বেল, পেঁপে, নিম, বহেড়া, হরীতকী, তুলসী, সজিনা, নারিকেল, সুপারি, বকুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।
৪) বসত বাড়ীর সীমানায় পুকুর থাকলে সেখানে বিভিন্ন ধরণের মাছের চাস করতে হবে। পুকুরের পাড়ে বিভিন্ ধরণের বৃক্ষ রোপণ (নারিকেল, সুপারি, ইপিল-ইপিল, মেহগনি, খেজুর, কড়ই ইত্যাদি) করতে হবে। এতে গরমের সময় মাছের উপকার হয়। এখানে বেশি শিকড়বিশিষ্ট গাছ লাগালে পুকুরের পাড়ের মাটি ভাঙবে না।
৫) বিভিন্ন ছায়াসহ্যকারী উদ্ভিদ যেমন: আদা, হলুদ ইত্যাদি দুই বৃক্ষের মাঝে লাগতে হবে।
৬) বসতবাড়ীতে যতটুকু সম্ভব গবাদী পশু পাখী (হাস, মুরগী, কোয়ল, কবুতর, গরু, ছাগল, মৌমাছি ইত্যাদি) পালন করতে হবে।
৭) সর্বোপরি স্থান/অবস্থান, উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা, সামর্থ, সহজপ্রাপ্যতা ইত্যাদি বিবেচনা করে বসতবাড়ীর কৃষিবনায়ন ধারার উপাদানসমূহ নির্বাচন করতে হবে এবং যথাযথ নিয়মে এর পরিচর্যা করতে হবে।
বসতবাড়ীতে পরিকল্পিত কৃষিবনায়নের প্রয়োজনীয়তা
কিন্তু এদশের অধিকাংশ জনগণই অত্যন্ত গরীব, অনেকের শুধুমাত্র বসতবাড়ী ছাড়া আর কোন কৃষি জমি নেই। অথচ এদেশের গ্রামাঞ্চলে বসত বাড়ীগুলো হচ্ছে সনাতন কৃষিবনায়ন ধারা তথা বহুমুখী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাচীন উদাহরণ। কৃষাণ-কৃষাণীগণ বহু পূর্বকাল থেকেই একই আঙ্গিনায় নিজেরা বসবাস করা ছাড়াও শাক-সবজী চাষ, গবাদীপশু ও হাসঁ-মুরগী পালন, মাছ চাষ, হরেক রকমের ফলদ, বনজ এবং শোভা বর্ধনকারী গাছ-পালা একই সঙ্গে উৎপাদন ও পালন করে আসছেন। বাংলাদেশে বসতবাড়ীর বাগান থেকেই অধিকাংশ ফল, কাঠ, জ্বালানী, পশুখাদ্য ইত্যাদি উৎপাদন ও সংগ্রহ করা হয়। দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গৃহস্থালী জ্বালানীর প্রায় ৮০ শতাংশ যোগান বসত বাড়ী এবং পাশ্ববর্তী জমি থেকেই আসে। তবে সুষ্ঠ পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতি থাকায় বসত বাড়ী ভিত্তিক এ উৎপাদন ব্যবস্থার ফলন তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধীকাংশ বসত বাড়ী এখনো প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্যবহৃত। ভৌত অবস্থান, কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাসম্পদ ভিত্তি ইত্যাদিকে বিবেচনায় রেখে কৃষিবনায়ন তথা একটি সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সেটা হবে আগামী শতকের প্রধান অবলম্বন, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বহু বছর ধরে খাদ্য, জ্বালানী ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যাদি যোগান দেবে। এছাড়া গাছ বায়ুমন্ডলের ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে, এবং ভূমি ক্ষয় রোধ করবে ও ঝড়-বাতাস থেকে ঘর-বাড়ীকে রক্ষা করবে। কৃষিবনায়ন আয়েরও একটি ভাল উৎস হতে পারে। তাই সুপরিকল্পিতভাবে কৃষিবনায়ন ধারা অনুসরণ করে বসত বাড়ীর আঙ্গিনা ও তার আশেপাশের জমি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল, শাক-সবজী, ফল,কাঠ, জ্বালানী, পশু খাদ্য, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি উৎপাদন করা একান্তই প্রয়োজন। এজন্য দ্রæত বর্ধনশীল ফলজ এবং বনজ বৃক্ষের সমন্বয়ে একটি বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য বসতবাড়ী বাগান গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে করে খাদ্যের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে বনভূমির পরিমান বৃদ্ধি পাবে এবং সে সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।