ইংরেজী নামঃ Mango
বৈজ্ঞানিক নামঃ Mangifera indica
পরিবারঃ Anacardiaceae
পরিচিতিঃ আম চির সবুজ বৃক্ষ। এ গাছের প্রধান কান্ডটি সরল এবং প্রকান্ড হয়ে থাকে। এর উপরই শাখা প্রশাখা জন্মে ক্রমে ছাতার রূপ নেয়। আম গাছ জাত বিশেষে ৭.৫-৩০.০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। এর বিস্তার ৬-১৮ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাতা দীর্ঘ, বর্শাকৃতি ও মসৃণ। পাতাগুলো প্রশাখার গায়ে সর্পিলাকারে বা স্পাইরালী বিন্যস্ত থাকে। শিকড় দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী।
পুষ্টিগুণঃ প্রচুর ক্যারোটিন, ভিটামিন-সি ও ক্যালোরি রয়েছে।
ঔষধিগুণঃ আয়ুর্বেদীয় ও ইউনানী পদ্ধতির চিকিৎসায় পাকা ফল ল্যাকজেটিভ, রোচক ও টনিক বা বলকারকরূপে ব্যবহৃত হয়। আম লিভার বা যকৃতের জন্য উপকারী। রাতকানা ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে পাকা আম এমনকি কাচা আম মহৌষধ। রক্ত পড়া বন্ধকরণে আম গাছের বিভিন্ন অঙ্গের রস উপকারী, কচি পাতার রস দাঁতের ব্যথা উপশমকারী। আমের শুকনো মুকুল পাতলা পায়খানা, পুরাতন আমাশয় এবং প্রসাবের জ্বালা যন্ত্রণা উপশম করে। গাছের আঁঠা পায়ের ফাটা ও চর্মরোগে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। জ্বর, বুকের ব্যথা, বহুমূত্র রোগের জন্য আমের পাতার চূর্ন ব্যবহৃত হয়।
জমি নির্বাচনঃ সুনিস্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি আম চাষের জন্য উত্তম।
জমি তৈরীঃ চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করতে হবে। সাধারনত ১৬ ই ফাল্গুন হতে ১৫ ই বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে জমি তৈরি করা হয়।
বংশবিস্তারঃ বীজ এবং কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায়।
রোপণ পদ্ধতিঃ সমতল ভূমিতে বর্গাকার, আয়তাকার বা ষড়ভূজী, পাহাড়ী ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে রোপণ করা যায়।
চারা রোপণের সময়ঃ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস (মধ্য মে থেকে মধ্য জুলাই) আম কলম লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়।
চারা রোপণের দুরত্বঃ ৮-১২ মিটার।
গর্ত খননঃ বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল-মধ্য মে) মাসে গর্ত খনন করতে হবে। প্রতিটি গতের্র আকার ১ মি. x ১মি. x ১মি. হবে।
প্রতি গর্তে সারের পরিমাণঃ
সারের নাম | সারের পরিমাণ |
জৈব সার | ১০-২০ কেজি |
টিএসপি | ৪৫০-৫৫০ গ্রাম |
এমপি | ২০০-৩০০ গ্রাম |
জিপসাম | ২০০-৩০০ গ্রাম |
জিংক সালফেট | ৪০-৬০ গ্রাম |
চারা রোপণঃ গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর চারার গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে। চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমাণ নিম্নরূপ হবে-
গাছ প্রতি সারের পরিমাণ | একক | গাছের বয়স (বছর) | |||||
০২-০৪ | ০৫-০৭ | ০৮-১০ | ১১-১৫ | ১৬-২০ | ২০-এর উর্ধ্বে | ||
গোবর বা আবর্জনা পঁচা সার | কেজি | ১০-১৫ | ১৬-২০ | ২১-২৫ | ২৬-৩০ | ৩২-৪০ | ৪১-৫০ |
ইউরিয়া | গ্রাম | ২৫০ | ৫০০ | ৭৫০ | ১০০০ | ১৫০০ | ২০০০ |
টিএসপি | গ্রাম | ২৫০ | ২৫০ | ৫০০ | ৫০০ | ৭৫০ | ১০০০ |
এমপি | গ্রাম | ১০০ | ২০০ | ২৫০ | ৩৫০ | ৪৫০ | ৫০০ |
জিপসাম | গ্রাম | ১০০ | ২০০ | ২৫০ | ৩৫০ | ৪৫০ | ৫০০ |
জিংক সালফেট | গ্রাম | ১০ | ১০ | ১৫ | ১৫ | ২০ | ২৫ |
উল্লেখিত সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম বার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় (মধ্য মে থেকে মধ্য জুলাই) মাসে এবং ২য় বার আশ্বিন (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর) মাসে প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম ও জিংক সালফেট এক বছর পর পর প্রয়োগ করলেই চলবে।
সেচ প্রয়োগঃ চারা গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর পরই হালকা পানি সেচ দিতে হবে। ফলন্ত গাছে মুকুল বের হবার ৩-৪ মাস আগে থেকে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। আমের মুকুল ফোটার শেষ পর্যায়ে ১ বার এবং ফল মটর দানার আকৃতি ধারন পর্যায়ে আবার ১ বার পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
ডাল ছাঁটাইকরনঃ গাছের প্রধান কান্ডটি যাতে সোজাভাবে ১ থেকে ১.৫ মিটার উঠে সেদিকে লক্ষ্য রেখে গাছের গোড়ার অপ্রয়োজনীয় শাখা কেটে ফেলতে হবে। গাছের ভিতরে যাতে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে তার জন্য অভ্যন্তরের অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত, শুকনো, মরা ও দুর্বল শাখাগুলি সর্বদাই কেটে রাখতে হবে। কলমের গাছের বয়স ৪ বছর পূর্ন না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙ্গে দিতে হবে।
রোগবালাই ও প্রতিকারঃ
রোগের নাম | রোগের লক্ষণ | প্রতিকার |
এ্যানথ্রাকনোজ | ১) গাছের পাতা, কান্ড, মুকুল ও ফলে ধূসর বাদামি রংয়ের দাগ পড়ে। ২) মুকুল ঝরে যায়, আমের গায়ে কালচে দাগ হয় এবং আম পঁচে যায়। | ১) আমের মৌসুম শেষে গাছের মরা ডালপালা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। কাটা অংশে বর্দোপেষ্ট (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন) লাগাতে হবে। ২) গাছের নিচে পড়া মরা পাতা পুড়ে ফেলতে হবে। ৩) গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ডাইথেন এম-৪৫, ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আমের আকার মটর দানার মত হলে ২য় বার স্প্রে করতে হবে। |
পাউডারী মিলডিউ | ১) আমের মুকুলে সাদা পাউডারের মত আবরন দেখা যায় এবং মুকুল ঝরে যায়। ২) আমের ত্বক খসখসে হয় এবং কুঁচকে যায়। | ১) গাছে মুকুল আসার পর এক বার এবং ফল মটর দানা আকারের হলে আর এক বার থিওভিট প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। |
ডাইব্যাক | ১) গাছের কচি ডালের আগা শুকিয়ে মরে যেতে থাকে। গাছের আম ঝরে পড়ে। | ১) সুস্থ অংশসহ ডাল কেটে ফেলতে হবে এবং ডায়থেন এম-৪৫ (০.২%) ব্যবহার করতে হবে। |
অনিষ্টকারী পোকা-মাকড় ও দমন ব্যবস্থাঃ
নাম | ক্ষতির ধরন | প্রতিকার |
আমের শোষক পোকা | ১) মুকুলের রস চুষে খায় এবং এতে মুকুল শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। ২) এই পোকা আঠালো মধুরস ত্যাগ করার কারনে মুকুলের পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটায়। এছাড়া ফুল ও পাতায় মধুরসের কারণে ভূষা ছত্রাকের জন্ম হয়। | ১) গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ফুল ফোটার পূর্বে প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মি.লি. সিমবুশ ১০ ইসি/ফেনম ১০ ইসি/বাসাথ্রিন ১০ ইসি মিশিয়ে পাতা, ফুল ও ডালপালায় স্প্রে করতে হবে। এর এক মাস পর একই পদ্ধতিতে আবার স্প্রে করতে হবে। |
আমের ভোমরা পোকা | ১) এই পোকার কীড়া কচি আম ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং ফল বড় হবার সাথে সাথে ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাইরে থেকে ফল ভাল দেখা গেলেও ভিতরে কীড়া পাওয়া যায়। | ১) প্রতি লিটার পানিতে ২ মি.লি. লিবাসিড ৫০ ইসি/সুমিথিয়ন ৫০ ইসি/ডায়াজিনন ৫০ ইসি মিশিয়ে ফল আসার ১০-১২ দিন পর থেকে ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। |
আমের মাছি পোকা | ১) আম পাকার সময় স্ত্রী মাছি আমের গা ছিদ্র করে আমের মধ্যে ডিম পাড়ে। ঐ সমস্ত ডিম হতে কীড়া বের হয়ে ফলের শাঁস খেতে থাকে এবং ঐ আম কাটলে তাতে অসংখ্য কীড়া বের হয়। | ১) ১ মি.লি ডেসিস ২.৫ ইসি প্রতি লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে আম সংগ্রহের ৩৫-৪০ দিন পূর্বে স্প্রে করতে হবে। এর ১৫ দিন পর আরও একবার স্প্রে করতে হবে। ২) গাছে আম পোক্ত হলে অর্থাৎ পাকার আগেই সংগ্রহ করতে হবে। |
অনিয়মিত ফল ধারন সমস্যার প্রতিকারঃ কোন কোন আম গাছে এক বছর আম ধরে কিন্তু পরের বছর বা ২-৩ বছর ফুল-ফল ধরে না। এজন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে-
– যেসব জাতের আম প্রতি বছর ফল দেয়, যেমন-হিমসাগর লাগানো যেতে পারে।
– বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে বাগানে চাষ দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।
– ফল সংগ্রহের পর গাছপ্রতি ১.৫ কেজি ইউরিয়া ব্যবহার করলে নতুন পাতা গজিয়ে ফুল-ফল ধরতে পারে।
– গাছের পরগাছাসহ মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল-পালা ভাদ্র মাসের দিকে ছেঁটে দিতে হবে।
– গাছের বাড়-বাড়তি বেশী হলে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বড় বড় ডালের বাকল গোল করে ২ সে.মি. পরিমান উঠিয়ে ফেলতে হবে।
– গাছের গোড়ার চারদিকে কুপিয়ে ৩-৪ কেজি লবণ দিয়ে পানি দিলেও উপকার পাওয়া যায়।
– হরমোন ছিটালেও গাছে ফুল ধরতে সহাযক হয়।
ফল ঝরার প্রতিকারঃ
– সুষম সার ও পরিমিত সেচ প্রদান
– পোকা-মাকড় ও রোগ দমন
– কম ফল ঝরে এমন জাত নির্বাচন
– পরাগায়নে সহায়তার জন্য বাগানে মৌমাছি পালন
– বাগানের চারদিকে বাত্যারোধী গাছ রোপন
– পরিমিত ছাটাইকরণ, নিয়মিতভাবে আন্তপরিচর্যাকরণ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক (২,৪-ডি ২০ পিপিএম) প্রয়োগ।
ফল সংগ্রহঃ কলমের গাছ থেকে বেশ তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায় কিন্তু বীজের গাছের জন্য প্রায় ৮-১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ফল ধরার ৩-৫ মাসের মধ্যেই ফল পরিণত বা বাত্তি হয়। তখন নিম্নোক্ত লক্ষনসমূহ দেখে ফল সংগ্রহ করতে হবে-
– বোঁটার নীচের অংশ কিছুটা হলুদাভ বর্ন ধারন করবে।
– আম পরিপক্ক অবস্থায় পানিতে ডুবে যাবে।
– দুই/একটা পাকা আম ঝরে পড়বে।
– আম পরিপক্ক হলে কস বের হয়ে দ্রুত শুকিয়ে যাবে।
একটি বয়স্ক গাছ ৫০০-৩০০০ টি ফল দিতে পারে।
সাথী ফসলের চাষঃ আমের চারা লাগানোর প্রথম ৫-৭ বছর পর্যন্ত শাক-সবজি, সরিষা, ছোলা, মসুর ও অন্যান্য ডাল, পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতির চাষ করা যায়। গাছ বড় হলেও আম বাগানে আদা, হলুদ, পান ইত্যাদির চাষ করা যেতে পারে।